গৌতম ঘোষ দস্তিদার

গৌতম ঘোষ দস্তিদার

শ্রীচরণেষু মা,
আজ তোমার জন্মদিন । পঁচাত্তর বছর আগের এমনই এক মাঝরাতে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে পাড়াপড়শি সবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো । সূর্যকে আড়াল কোরে তুমি এলে যেন । সবাই নাকি সেদিন ভেবেছিলো – নোতুন কোনো তারকা বুঝি আলো নিয়ে এলো এক পশলা । সে কি সাংঘাতিক একটা উদ্দীপনার উদয় হোলো আকস্মিক । পূর্বপুরুষের কাছে কতো বারবার শুনেছি সে কাহিনী !
কিন্তু সব উদযাপন সব উদ্যম সব উত্তাপ অনতিদূরের এক মুহূর্তে মুছে গ্যালো । কোন ষড়যন্ত্রে কোন দেশদ্রোহিতার মন্ত্রে উদবুদ্ধ হোলো কিছু অকৃতজ্ঞ প্রাণ – কিছু ক্ষণিকের অভিমান – কিছু বেদনাদগ্ধ গান । ভাগ করো আর ভোগ করো – এই দুর্নীতিতে বলীয়ান হোয়ে সে প্রায় তিনশো বছর ধরে যাঁরা এ মাটিকে বিক্রীত কোরে এসেছিলো – বা বলা চলে – বিকৃত কোরে এসেছিলো – তাঁরাই তাঁদের গবেষণাগারের রসায়ন দিয়ে পদার্থ দিয়ে অপদার্থ পন্থায় প্রস্তুত জীবাণুর বিষ ঢেলে দিয়ে গ্যালো তোমার বেড়ে ওঠা ভ্রূণে । আবির্ভাবের দিনেই তুমি অঙ্গ খোয়ালে, পঙ্গু হোলে মাগো !
পরের গল্পটা আর না-ই বা মনে করালাম বছর ঘুরে ফিরে আসা আজ সেই জন্মলগ্নে । সূর্য প্রদক্ষিণ কোরে আরও একবার ঘুরে এলে তুমি এরই মধ্যে । আরো অনেকবার আরো শত সহস্রবার এমনি ভাবেই তুমি নিকটতম নক্ষত্রের চারপাশ ঘুরে আসবে, জানি মাগো । কিন্তু তবু জানিনা কেন, তোমার জন্মদিন এলেই আমার বুক জুড়ে বৃষ্টি নেমে আসে, সীমান্ত জুড়ে নেমে আসে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীর ঢল, দু চোখে তাদের বানভাসি – অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় ডুকরে ওঠা আকুতি । সেই তরল একদা বাষ্পরূপ ধারণ করে । পদ্মা সিন্ধুতে ভেসে ওঠে শবদেহ আর সন্দেহ । গোটা অস্তিত্ব তখন ছেয়ে যায় মেঘে মেঘে ।
তুমি আঁতুড়ে তখনো অথচ তোমার পিতৃত্ব নিয়ে লেগে গ্যালো কোলাহল । সেই কলহপ্রেম, উত্তরাধিকার নিয়ে সেই প্রতিযোগিতা আজও দিব্যি রয়েছে জারি, চলেছে প্রকাশ্যে তার মহড়া । খাস ইতিহাসও তার কাছে মাথানত কোরে মুখ নিচু কোরে দাঁড়িয়ে আছে । আজাদির সেই মধ্যরাতে কী পেলে তাহোলে সেদিন ? শুধু বঞ্চনা, শুধু বেদনার একটানা এক মহাকাব্য – মহাপয়ারের একঘেয়ে ছন্দে লেখা যেন । মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবারের ভুঁইফোঁড় হোয়ে ওঠা । উপেন নামের ভূমিপুত্রকে যাবতীয় অস্বীকৃতি জানিয়ে কেড়ে নেওয়া তাঁদের চাষাজমি । শিল্পের আড়ালে সেখানে চলে তখন আপামর অবৈধ আদিম ব্যবসা ।
সেই অপকর্মকে ক্রমশ প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি এই আমরা – তোমার সন্তান সন্ততিরা । মুখ বুজে সয়ে আছি সব পাপ – জাতের নামে বজ্জাতি সব । এখনো তবু বিশ্বাস – বুকে আছে বিশ্বাস – আমরা কোরবো জয় নিশ্চয় । একদিন না একদিন আমাদের সহ্য-নদি পাগলপারা হোয়ে বয়ে যাবে সমতল ছাপিয়ে । দেখে নিয়ো তুমি – ঠিক যাবে । আর সেদিন তো বেশি দূরে নয় । আজ কাল পরশু তরশুর ভিতর সেই ছন্দবিহীন ছন্নছাড়া কবিতার প্রায়টা শুরু হোয়ে যাবে ।
সেদিন আমি তোমার কাছে থাকতে পারবো না, মাগো । তোমার কাছে পড়ে থাকা এই অস্থায়ি ভাড়াবাড়িটা ছেড়ে আমার আপন ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে হবে তার বহু আগে । আমি ওপার থেকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো, তুমি আপন আনন্দে সেদিন আত্মহারা । তোমাকে দেখবো, দুহাত তুলে তুমি তখন নেচে চলেছো নিজেরই ছন্দে, গেয়ে চলেছো আবার নোতুন কোরে ভুলে যাওয়া সেই গান ।
সেদিনই তোমার সত্যিকারের জন্মদিন জেনো মাগো ! সেদিনই তোমার আগমনী ! সেদিন আবার তোমার চণ্ডাল ছেলেমেয়েরা মূর্খ ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভেদাভেদ সব শিকেয় তুলে, বিচ্ছেদ-বিভাজন সব ভুলে তোমার কাছে ছুটে আসবে । চুমুতে চুমুতে তোমায় অস্থির কোরে দেবে । আর ঠোঁটে থাকবে জন্মদিবসের সঙ্গীত – বন্দে মাতরম – জয় হিন্দ !
আমার প্রণাম নিয়ো মাগো !
তোমার দীনহীন অক্ষম জনৈক সন্তান !

Leave a Reply