কৌশিক চক্রবর্ত্তী
প্রিয় দক্ষিণ বারান্দা, কেউ কখনো চিৎকার করে কিছু বলতো মাছরাঙা দ্বীপের পাড় ঘেঁষে। রোজ বলতো, কাছে যেতে বলতো, কিছু রেখেও যেতে বলতো। তুমি তো জানোই আমি মিথ্যে বলি না। অতএব চোখের আশপাশ লালবর্ণ হলেই আমি বেপরোয়া হয়ে উঠতে জানি। ঝাঁপিয়েও পড়তে জানি জ্যোৎস্নায়, আশ্বাসের সমুদ্রে। দ্বীপ খুব নিরাপদ জায়গা জানো তো? সেখানে বিড়ালে রাস্তা কাটার ভয় থাকে না, ক্রমান্বয়ে বন্যাকবলিত হলেও সর্বস্বান্ত সাজাবার রক্তচক্ষু থাকে না। সেখানে যেটুকু উষ্ণতা থাকে, তাও শীতের প্রতিমাভেদে নতজানু। আজ নিরন্তর বুকে খেজুর গাছের হাঁড়ি বেঁধে জলে ভেসে চলার টান —– আরে না না, এ আমার প্রথাগত কবিতা নয়। উপরন্তু দেখো সত্ত্বগুলো বাঁধা পড়ছে। কিন্তু আর লিখতে ইচ্ছে করছে কই? আজ সকালটা কখন আবার আলস্য সেজে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে একা। যথারীতি, সঙ্গে কেউ নেই জানো; বৃষ্টি ভেবে আমি যেই খুলে দিয়েছিলাম উত্তরের সেই মণ্ডপ সাজানো মুক্তাঙ্গন, সঙ্গে সঙ্গে তীব্র পিপাসার মত কে যেন জড়িয়ে ধরেছিলো। তুমি কি ছিলে তার সঙ্গে মিশে? ছিলে একসাথে আকাশের হাত ধরে? তোমার সাথে ভাব করবো বলে আমি রোজ আয়নার সামনে অভ্যাস করতাম শব্দনিক্ষেপ। সে শব্দ চিত্রাঙ্গদা হয়ে অর্জুনের তুণে সুরক্ষিত ছিল কিনা জানা নেই, তবে পর্ণমোচী গাছে ভাবগম্ভীর কুয়াশার বাস্প সেজে তা বহুক্ষণ আলগা লেগে থাকতে পারতো। ঘাসে শিশির পড়ার শব্দও যখন বিরক্তির সঞ্চার করতো, আমি তখনই বুঝতাম তুমি আমার থেকে অনেক দূরে রয়েছো। আজ সকাল থেকেই জানলার কাঁচে প্রতিবিম্ব আবছা। শীত কোথা থেকে এলো, আর চেয়ে নিয়ে গেলো অনেকগুলো প্রতিশ্রুতি? ঘাসের শহরে জোব্বা পরিয়ে সবটা লুকিয়ে রাখবে ভেবেছিল বটে। কিন্তু কই? পারেনি তো! সে তো আড়াল সরিয়ে বেশ ভেঙেছে। আয়নার কাঁচে আলতার রঙ দেখা না গেলেও ভোরে কার্নিশ ভেজার স্মৃতি বেশ স্পষ্ট। আমি আজকাল রোজ ভাবি তোমার মতন করে লণ্ঠনটা বুকে রাখবো। সে যেন প্রতি রাত্রে তোমার দেয়ালের আনাচেকানাচে শুধু নিশ্বাসের বাষ্প হয়েই লেগে থাকে; একরোখা কুয়াশার খামখেয়ালিপনায় নির্লজ্জ ভাবে নিরাভরণ না হয়ে পড়ে। এ চিঠির উত্তর হয়ত সেদিনই আসবে যেদিন সময়ের ফরিয়াদ গুনতে গুনতে আমি আয়নার এই শীর্ণ কাঁচকে একটা মুক্ত প্রাসাদ ভাবতে পারবো। প্রতিদিনের ভারাক্রান্ত অভিনয়গুলো যেদিন তোমার মত করে পূর্ণতার রূপ নেবে, সেইদিনটা আমার আসল উপলব্ধি হয়ে ছুঁয়ে যাবে প্রতিটি শীতের দুপুর। আজকাল সমুদ্রের ঢেউ থেকে ‘মুক্ত’ বেছে নিতে শিখেছি। আজ মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা। যেদিন তুমি চোখে আঙুল দিয়ে আমার ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছিলে, সেটাও একটা শীতের বিকেল ছিল। আজ আমি এই সময়কে একটা আস্ত মহাকাব্য মনে করতে পারি, হয়ত এ শহর তার সাক্ষও দেবে; কিন্তু আবার তৈরি হবে না আরো একটা মায়াসমুদ্র। আজ মনে হয় মেঘ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সবটাই পৃথিবী হয়ে গেছে। একটা হেমন্ত যায়, ফিরে আসে শীত। প্রকারান্তরে উদাস হয় নদীপথ, নৌকার গতি আর গন্তব্যের দূরত্ব। তুমি কি আজও সে’দিকের খবর রাখো? পাখিরা হয়ত আবার খাঁচা থেকে মুক্তি চাইবে, চেয়েই যাবে। কিন্তু গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত – ঋতুবৈচিত্র নির্বিশেষে আমরা তাকে কখনোই প্রশ্রয় দিতে পারবো না। তাই তুমি আর তার মায়া বাড়িও না। একএকটি হেমন্ত যাবে, চায়ের পেয়ালায় লাগবে নতুন অপরাধবোধ। তবু তো সময় ফিরে ফিরে আসবেই, আর তোমার জন্য নতুন করে আয়নার কাঁচে, লন্ঠনের আলোয় আর দেয়ালের গায়ে ভোরের কুয়াশা ছড়িয়ে রাখবো আমি। পারলে একবার ছুঁয়ে দেখো। অমরত্ব না থাকলেও, এতে হয়ত পৃথিবীটা মিশে আছে। আর তুমি তো জানোই যে, পৃথিবীটাই অমর নয়। তাই না? ………..এই শেষ নয় এই শুধু নয় মেহগনি পথ এখনো অনেক স্বপ্ন বাকি শীতের দোতারা থেকে লালমাটি, অঙ্কুর… সন্ধ্যে নামার আগে হেঁটে যাবার অক্ষরচিহ্ন; এটুকুই রাতের প্রকাশে ছায়ানট, অক্ষয়সিঁদুর! সমস্ত পর্দার পিছনেই রেখে এসো ফুলসজ্জার তিথি, কোনো দখলদারি ভোরেই তুমি একা নও আর- ছেয়ে যাচ্ছে কুমারী রোদ্দুর আর শোনা যাচ্ছে আজান… অর্থসার… এই শীত প্রেমিকা হলে তুমি তার ঠোঁটজুড়ে অনুতপ্ত ‘লুৎফুন্নিসা’… ইতি ‘আত্ম’দরজা…. |