ঐশীপ্রমা ভৌমিক

ঐশীপ্রমা ভৌমিক

প্রিয় ত্রক্ষ্য ,   


                বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। অনেকক্ষণ ধরেই ছাতারে দুটো ভিজছিল । এখন পালিয়েছে । মেঘ একটু কাটতেই আবার একঘেয়ে দুপুর । কতদিন দেখা নেই তোমার সাথে । চুপ করে তাকিয়ে আছি জমা জলটার দিকে । নীল আকাশের ছায়া আলতো হয়ে দুলছে সেখানে । রাত পেরোতেই কামিনীর পাঁপড়িগুলো আলগা হয়েছে । মাটির সাথে ওদের চিরকালের টান । আর বর্ষা ওদের প্রেমের সাক্ষী । কে কোথায় দুঃখ পেয়েছিল, আঘাত পেয়ে খসে গিয়েছিল ,সে সবেরই হিসেবে আছে তার কাছে। যাইহোক কেমন চলছে তোমার, বলো? তুমি কি উপরের ঘরে বসে পড়ছো এই চিঠি? হেলান দিয়েছো বিছানার একটা পাশে? তুমি যে কোথায় আছো কেমন করে আছো ,সারাদিন যেন আমি তাই ভেবে চলি অনবরত । মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তোমার আমার মাঝের পথটা বাসরলতার ছাউনি ফেলে সাজিয়ে দিই । যে মাটির উপর দিয়ে তুমি হেঁটে চলো সেই পথটাকে পর্তুলিকা দিয়ে ভরিয়ে রাখি । বেরঙের এই জীবন , ফিকে হওয়া আকাশ , এখানে কেবল তুমিই তো এক ছিটে রঙ । একটামাত্র আলোর বিন্দু । আমি পথ হারিয়েই তোমাকে পেয়েছি , কিন্তু তোমাকে হারিয়ে আর পথ পাইনি । তাই তো এত মনে পড়া । যে সব ব্যথা গোপন ভীষন , ঈশ্বরকেও বলা যায়না সেসব আমি তোমাকে দেখিয়েছি ।আসলে তুমি ফিরবে বলেই তো অপেক্ষা । তুমি দেখবে বলেই তো এত সাজ , আমার সমস্ত অকারণ আয়োজন আসলে কার জন্য! তুমিই তো । তোমারই জন্য সব ‌। এটুকুই সুখ । তুমি আমার বর্ষার সেই বিকেল যেখানে টিটি পাখির ডাক আবছা হয়ে আসে ।‌মজে যাওয়া পুকুরে সবুজ বুদবুদ উঠে মিলিয়ে যায় । ফুরিয়ে যাওয়া মুহূর্তে একবার ফিরে তাকিয়ে যায় মাছরাঙা । আজকাল দেখেছো বৃষ্টিও বড় অসময়ে নামে । মাঠঘাট ছাপিয়ে ওঠে ‌। জলফড়িংগুলো সারা মাঠ দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় । মনে পড়ে, খুব ছোটোবেলায় ফড়িং ধরে তার পেটে সুতোর গিঁট বেঁধে দিতাম । না জানি সেই সুতোর বাঁধন আর কোনদিন সে ছাড়াতে পারতো কিনা ! শিরীষের বনে কত এলোমেলো ঘুরতো হয়তো । বড় মায়া হয় এখন । বাঁধনে সবাই বাঁধতে পারে জানো । কিন্তু তারপর ফড়িঙের কী হয় সেই খবরটা কেউ নেয়না । আর তুমি! তুমি কাউকে বাঁধনে বাঁধো না । ওটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় বাঁধন । যে ফড়িং সুতো সমেত আর কখনো ফিরে আসেনা সে হয়তো বিনা বাঁধনেই তোমার কাছে ধরা দেয় । তাই তো চোখে হারাই তোমায় । এই তো জাদু তোমার । এক মুহুর্তে ফিকে হওয়া জীবনকেও রঙীন করে দিতে পারো । আবার কখনও চাইলেই সে সমস্ত রংকে নষ্টও করতে পারো । এসব জাদু শেখা যায় না । চোখ ভরে তাই শুধু দেখি। জানো তো! আজ একটা হলদে রঙা প্রজাপতি এসেছিল । পাশের বাড়ির ছাদ ফাটিয়ে একটা নয়নতারা গাছ হয়েছে। ওর সাথে লুকোচুরি খেলছিল । বেশ খানিকটা বাদ চলেও গেল । কিন্তু নয়নতারা গাছটা এখনো আনন্দে মাথা দুলিয়ে চলেছে। কে জানে ও আবার ফিরবে কিনা ! এমন তো কতবার হয় বলো! কখনো পথ হারিয়ে যায় । কখনো চেনা হয় অচেনা। কিন্তু আমরা অপেক্ষা করি । কেবল ভালোবাসি সেইজন্যই । আবার অনেকবার এমনও হয় যে ফিরতি পথে কেউ ঝুলিতে ভরে আনে দ্বিগুণ খুশি। সেসব দিন কাটে ঘোরের মতন ।‌ বিশ্বাস হয়না সদ্যফোটা শিউলিকেও। আমার বাড়িতে বারোমাসি শেফালির গাছ । টবের কাছে সারা বছর একটা দুটো ফুল পড়ে থাকে । আর সেবার সরস্বতী পুজোয় খানিকটা হলুদ বেটে খানিকটা ওই টবের মাটিতেই ফেলেছিলাম জানো! কে জানত গাছ হবে ! আমি ভীষন খুশী হয়েছি ওর পাতা দেখে । বেশ আছে ওরা । ইশশ দেখো কেমন অসংলগ্ন কথা বলি আমি! এই চিঠি তুমি ছাড়া আর কারোর বোঝবার সাধ্যি হবে না জানো! কী করবো বলো যখন লিখতে বসি তখন নানান কথা মনে পড়ে। ইচ্ছে করে সবটুকু তোমাকে জানাই । অথচ চিঠির শেষে কত কথা যে বাদ পড়ে যায় ! তোমার আমার মাঝে এই কাগজ-কলম টুকুই আছে বলো? কবে আবার দেখা হবে সে কি আমি জানি?  
       যাইহোক পুজো আসতে আর বেশি দেরী নেই । পুরোনো পোশাক পরে পুজো কাটিও না। সবার কথা যেমন ভাবো নিজেকে নিয়েও একটু ভেবো । যতদিন কাছে নেই অবাধ্য হবেনা। ভোর রাতে ঘরের জানলা বন্ধ করে দিও । সেইসময়ের হাওয়ায় বড় জ্বর আসে । জ্বরের রাতে বড্ড ভুল বকো তুমি । ছেলেমানুষ হয়ে পড়ো । তখন তোমাকে সামলানো এক বিরাট ঝক্কি। অবশ্য আমায় নাকাল করে তোমার বড় সুখ হয় জানি । কিন্তু এমন সুখের তো দরকার নেই তাই খাওয়াদাওয়া সময় মতন করবে। আর ঘুমাতে বেশী রাত করবেনা । লক্ষ্মীটি হয়ে থাকবে ।আজ আমি চিঠি এখানেই থামাবো। ভালো থাকবে । আমাদের জলদিই হবে। চিঠির ভাঁজে আদর রইলো । 


                                          ইতি 
                            তোমার আদরের শৈলেয়ী

Leave a Reply