এলা বসু
মাগো, বড়ো পিপাসা! গলা শুকিয়ে আসছে। তোমাকে ডাকব বলে নীল কালি, তোমাকে লিখব বলে সাদা থান কাপড়ের মত কাগজ খুলে বসে আছি মা! যদিও এ এক অনন্ত চিঠি, তবু শুরুটা হোক নির্দিষ্ট কোনো সময়ে… ধরো যখন প্রথম স্কুলে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম আর পেট ব্যথার অজুহাতে স্কুল কামাই করা অভ্যেস করে ফেলছিলাম, তুমি পরম যত্নে প্রাইমারি সেকশনের ছোট জ্যোৎস্নাদিকে বলেছিলে আমাকে দেখে রাখতে আর আমি কাঁদলেই তিনি কোলে করে ঘোরাতেন। জ্যোৎস্নাদির সেই বিরক্তিহীন স্নেহপ্রবণ মুখ, আদরের মুহূর্তগুলো অনেক অনেক মেঘের ওপারে আজ। হাত বাড়ালেও ছুঁতে পারিনা। শুনেছি সেই ছোট জ্যোৎস্নাদি শেষ বয়সে পয়সার অভাবে বড়ো কষ্টে ছিলেন, এমনিতেও থাইরয়েডে তাঁর গলার বাইরের বিশাল মাংসপিন্ড তাঁকে এক দেখাতেই অসুস্থ বলে চিহ্নিত করে ফেলা সহজ করে এনেছিল। পরের লাফে চলে যাচ্ছি সেই শীতের সকালে যখন নাচের বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকি নিচে আর বাড়িওয়ালির মেয়ে পাকুদিরা থাকে ওপরে। ওদের ফুলের বাগান আমাদের ঘরের সামনে। লোভবশত একটা গোলাপ ছিঁড়ে ফেলেছি আর পাকুদি ছোট্ট আমাকে কঠোর রাগী গলায় বলে চলেছে “তোমার যেমন আঙ্গুল কাটলে ব্যথা লাগে, গাছেরও তেমনি…” তুমি রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে আমাকে বাঁচালে তার সুতীক্ষ্ণ জিভের হাত থেকে। ছেলেবেলা জ্বর হলেই মজুমদার ডাক্তারবাবুর কাছে দৌড়নো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, তিনি একটা পিত্তি সবুজ রঙের ড্রেস পরে বসে থাকতেন । তোমার সাথে রিক্সা করে যেতাম আর জ্বর হয়েছে বলে তুমি একবার আদর করে লাল আলোজ্বলা বন্দুক কিনে দিয়েছিলে বলে সে কি আনন্দ! হাতে যেন চাঁদ পেয়েছিলাম! ওষুধ মানেই শকিং গোলাপি রঙের বিশাল বড়ো ট্যাবলেট আজিথ্রোমাইসিন তার অতি বিদঘুটে গন্ধ সমেত গিলে ফেলা অবশ্য কর্তব্য, তুমি মাঝেমাঝে জাতি দিয়ে কেটে দিতে গিলতে না পারলে। কতদিন হলো কাউকে অভিমান লিখিনি, শূন্যের উত্তরে শূন্য ভিড়িয়ে দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত বিষণ্ণ আঙ্গুলগুলো বিরতি চায় মাগো! মনে আছে কম বয়েস থেকেই আমার ইমিউনিটি কম ছিল। সারাক্ষণ হাঁচি ছিল সঙ্গী আর একবার শুরু হলে পাঁচশোটার আগে থামতোনা, তুমি মুহূর্তের মধ্যে রিক্সা করে গিয়ে মৃণাল বা ভার্মা ডাক্তারের থেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ এনে দিতে। কয়েক দানা খেলেই হাঁচি থামতো আর আমি পড়াশুনো করে পরেরদিন নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে যেতাম। সেকেন্ডে সেকেন্ডে তুমি আমায় এসব বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিতে। খুব খুব ভুগতাম আমি আর খুব ঘরকুনো ছিলাম, ঘরে থাকতে এত ভালোবাসতাম যে দিদিরা কলেজ কি বন্ধুদের বাড়ি থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় অনেক বকা খেত কিন্তু আমি প্রায় কক্ষনো খাইনি বকা সেসব কারণে। বলোতো মা, তোমার এই মারাত্মক মনের জোরের এক অংশ ও পেলাম না কেন? জীবনকে তুমি নিংড়ে নিতে জানতে, সে জ্বলুয়ার দোকানের কচুরি জিলিপি খেয়েই হোক আর বাবির সঙ্গে খেলা করেই হোক না কেন, জীবন তোমার ছিল প্রতিমুহূর্ত উদযাপন! তাইতো এতো বড়ো অসুখ নিয়েও এতগুলো বছর কেমন মোকাবিলা করে গেলে অমলিন মুখে! সেবার যখন আমি আপটেক থেকে কম্পিউটার ক্লাস সেরে বাড়ি ফিরে পড়ন্ত সূর্যের তেরছা আলোয় তোমার মুখটা দেখলাম একদম হলুদ, সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ল তোমার হেপাটাইটিস বি আর গোলপার্কের আমরিতে এক মাস মরণ বাঁচনের লড়াই সেরে পরদিনই তুমি তেল ঝাল মশলা দেওয়া রগরগে রান্না খাচ্ছ পরম তৃপ্তির সাথে আর আমার বন্ধু সৌমেনের তোমাকে বাড়িতে দেখতে এসে ঐ অবস্থায় দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা! হ্যাঁ এটাই তোমার ইউ এস পি! বাঁচতে হলে বাঁচব বাঁচার মতন করে চুটিয়ে! তখন আমি তোমার চিকিৎসার বিষয়ে প্রায় একমাত্র অভিভাবক ছিলাম। দুই দিদিই বিয়ের পরে বাইরে, যে নেফ্রলজিস্ট তোমাকে দেখলেন, তাঁর হাবেভাবে আশ্বাস তো পেলামইনা বরং যা পেলাম তা হলো আতঙ্ক, ডায়ালিসিস এর আতঙ্ক! তবু আগে পরে আর কোনো ভালো ডাক্তার পাচ্ছিলামনা, তিনি দেখেছেন শুনে কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলবে না, সেসবের মধ্যেই আমার বিয়ের ঘন্টা বাজল, দেখো! মনে আছে, হয়তো শরীরের কারণে বা ছোট মেয়ে চলে যাওয়ার দুঃখে, আমার বিয়ের কোনো ব্যাপারেই তুমি খুব ভিতরে ঢোকোনি, সে গয়না পছন্দই হোক আর কার্ড পছন্দই হোক। নাকি অশনি সংকেত কিছু পেয়েছিলে আশীর্বাদের দিনে যখন পাত্রপক্ষ জানায় আচমকা যে আমাকে ওরা এক বছর আসতে দেবেনা বাপের বাড়ি? বিয়ে এত আতঙ্কের হয় যদি জানতাম মা! যদি জানতাম সেসব আতঙ্ক বিয়ের পরেও পায়ে পায়ে ঘোরে প্রেতছায়ার মতন, নিজের ছায়াও হাত ছেড়ে অবলীলায় ঝোলের দিকে গড়িয়ে যায়, হায়! এই সে জীবন! যার স্বপ্ন দেখেছি ছোট থেকে! তোমরাই তো বলতে আমি এত সুন্দর যে বর মাথায় করে রাখবে! পাশেই পাতকুয়ো আর দড়ি কলসি মজুত থাকবে তা যদি বলে দিতে! “দেবে না ভালোবাসা দেবে না আলো সদাই মনে হয় আঁধার ছায়াময় দীঘির সেই জল শীতল কালো তাহার কোলে গিয়ে মরণ ভালো “ সে যাক, ভয়ে গলা শুকোতে শুরু করেছিল বৌভাতের রাত থেকে। তোমাদের দেওয়াথোয়া তাঁদের মনে ধরেনি, শ্বশুরকে কাকু ডাকার সৌভাগ্য কজনের হয়েছে জানিনা আমার মতন, তবু সেই দিন থেকে তোমার আদরের হদ্দ বোকা মেয়ে জান লাগিয়ে দিয়েছিল ” সে ভালো মেয়ে, ভালো বৌ ” এই কথাটা একবার মাত্র শুনবে বলে l ট্রেনে করে ভুবনেশ্বর যেতে যেতে মন বলছিল, তুমি যদি ওই আকাশের মেঘেদের মধ্যে হারিয়ে যাও সেই তোতাপাখির গানের মতন! বিয়ের পরে চার বছর মা হওয়ার চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখাও মূলত সেই কারণে, যদি সন্তানের যত্নের কারণে তোমার অযত্ন করে ফেলি! ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল অবধি তোমাকে ডায়ালিসিস ছাড়া বাঁচিয়ে রাখা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল! উৎরে গেছি। তোমার অসুখের ভয়ে জানাতে পারিনি কি চরম অসুখী হয়েছিলাম আমি বিয়ের পর, কী কী ভয়ঙ্কর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার ভোগ করেছি, সেসবের আভাস তুমি ভালোমতন পেয়েছ যদিও ক্রমশঃ পরবর্তী জীবনে । তবু অভিমান ছিল, জানো, সেই জামাইকে অত যত্ন করতে কেন? ইলিশ মাছ, আম কি কি না খাওয়াতে যত্ন করে বসিয়ে বসিয়ে! আর আমার তো প্রথম বছর চা ও জোটেনি কপালে! কাগজ দেখে বিয়ে কিনা, এমন লজ্জাবতী ছিলাম, চা খেতে চাই সেটাও বলতে পারিনি, দোষ তোমাদের নয়! আমার ভাগ্যের! সে যাক, তারপরে তো ঘর আলো করে জীবন জুড়ায়ে সে এলো! এলো তোমার নাতি আর আমার ছোট্টসোনা বাবি। শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায় নতুন লড়াই সাথে নিয়ে এক মানসিক অসুখ ওসিডি। লড়াই খুব সহজ ছিলনা তুমি জানো সেসব, তুমি আমার সহায় হয়েছিলে হাসপাতালের আর আইসিইউর দিনগুলো ছাড়া! মাত্রাতিরিক্ত রকমের বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়লাম ছেলের জন্মের পর থেকে। তুমি ছিলে মা গো সারাক্ষণ, ছেলের সামান্য কি বড়ো বিপদে বুক দিয়ে করতে তুমি। বুষ্টার ডোজে বাবাকে ঠেলে পাঠাতে আমার সাথে। আমার একা ছেলেকে নিয়ে যেতে ভয় করত চিরকাল ছোটতে বিশেষত। মধ্যে মধ্যে তোমার ক্রিয়াটিনিন যেত বেড়ে । আমাদের বোনেদের বুক ধড়াস ধড়াস করতো, ফোনে মিটিং চলত তিন মাথার। পরে ডাক্তার দেখানোর জন্য তোমাকে নিয়ে দৌড়োতাম আমি আর বাবা, বাড়িতে ছেলেকে দেখত রমাদি… এভাবে চলতে চলতে বছরে নিদেনপক্ষে একবার তুমি পীয়ারলেসের আইসিইউতে ভর্তি হতে । আর আমি টাকার চিন্তা, তোমার চিন্তা, ডাক্তারের সাথে কথা বলা আর ঘর সামলানো সব একসাথে করতাম… তখন বাবি খুব দুর্গাঠাকুর আঁকত আর দুর্গাঠাকুর দেখিয়ে বলতো এটা ওর মা । ক্রাইসিসে মেয়েদের দশভুজা না হয়ে তো উপায় থাকেনা, হতেই হয় । বাড়িতে ফিরে আবার একটা ঘরে অনেক সময় তুমি শুয়ে থাকতে আয়া সমেত, তোমার ইউরিন স্বাভাবিক হতোনা । ক্যাথিড্রাল লাগানো থাকতো । সেই সময়গুলোও বেশ কঠিন ছিল । বাবিকে সামলে তোমার ইউরিন আউটপুট মাপা, কিছু এদিক ওদিক দেখলে দিদিদের ও ডাক্তারকে জানানো । তোমাকে কলকাতার বেস্ট নেফ্রলজিস্ট দেখত তাই সহজে তাঁর ফোন পাওয়াও যেত না । বাড়িতে তখন উত্তম আসতো ব্লাড কালেক্ট করতে… কি অমলিন হাসি! কি ভালো ছেলে মা গো! অথচ তার প্রথম ছেলে জন্মাবধি শয্যাশায়ী ছিল নার্ভ এর অসুখে। বৈষ্ণব ছিল উত্তম! কখনো তাকে বিরক্ত হতে দেখিনি আর ছিল রায়ের দোকানের ছেলেটি। সে আসতো সুগার এর ইনজেকশন মানে ইনসুলিন দিতে তোমাকে। আমাদের এই যাবতীয় দমবন্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ফেলতাম বাবিকে পাওয়ার আনন্দে আর তোমাকে হারানোর ভয়ে! মৈত্রকাকুর কথা মনে পড়ে মা? তোমাদের কি সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল বলো? এত ভালো বন্ধু তোমার আর আমাদের এত ভালো কাকু পাওয়া কপালই বলতে হবে… আমার সাধে সবথেকে দামি শাড়ী কাকুই দিয়েছিলো, আর যখন সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেকে হাসপাতাল থেকে সোজা বাপের বাড়ি নিয়ে গিয়ে আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শী সকলের সামনে মুখ কালো আর আড়ালে মুচকি হাসি কুড়োতাম, তখন সবথেকে কাছে পেয়েছিলাম এই কাকুকে… রক্ত যে কিছু সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করাতে ব্যর্থ এটা তো মানতেই হবে! আস্তে আস্তে দিন গড়িয়ে বিকেল বিকেল গড়িয়ে সন্ধে এলো । তোমার ভুবন আলো করা নাতিকে নিয়ে আমি পুনরায় বাবির বাবার সদ্য কেনা ফ্ল্যাটে চলে এলাম সন্তোষপুরে। তার দুই বছরের মধ্যেই বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ল। যে মানুষটাকে কেউ রিক্সায় চড়তে আর ডাক্তারকে ফিজ দিতে দেখেনি, সে হঠাৎ করেই চলে গেল। আমি আর ছোড়দি প্রায় জোর করেই বাবাকে অপারেশন করালাম, এমন ভয় দেখালো ডাক্তার। বাবার জানোতো, মোটেই ইচ্ছা ছিলনা, রুবি হাসপাতালে গিয়েও সেদিন সকালে বলেছে, “তোর মা কাঁদছিলো, বলছিলো যদি আর না ফিরি” এমন সব ইমোশনাল কথা বাবা ক্কচিৎ বলতো আর আমি এমন আহাম্মক, বাবার বয়সের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে এটাই ভেবেছি যে বাবা তো চির যুবক! হাসপাতালে ভর্তি হবার আগেরদিন অবধি রায়ের ওষুধের দোকান থেকে নিজে হেঁটে ওষুধ কিনে ফিরেছে, সে তো হেঁটেই যাবে আর হেঁটেই ফিরবে, জানা কথা! জীবনে কত কিছুই যে ধরে নিই, নব্বই শতাংশই ভুল প্রমাণিত হয়, তবু ধরার অভ্যাস ছাড়তে পারিনা মা, বাবা কিন্তু হেঁটে ফেরেনি আর বাড়ি… তুমিতো জানো মা, বাবা আমার চা খাওয়ার, শীতে কফি খাওয়ার প্রিয় সঙ্গী ছিল । তখন বাবার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে, মুখে রাইলস টিউব, সেপ্তিসিমিয়া শরীরে ভালোরকম ঢুকে পড়েছে, আমাকে বলছে বাবা ভিজিটিং আওয়ার্সএ , ঠিক সেই সময় আমরা দ্বিতীয় কাপ চা খেতাম বাড়িতে জানো, বাবা বলছে “হ্যাঁ রে, এরা ভাত দেয়না তো… ” আমি বললাম “না বাবা রাইলস টিউবে দিচ্ছে তো! ” তারপর বললো “এরা চা ও দেয়না, এই সময়ে চা খাই না আরেকবার? ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম একদম ঠিক বলছে! সেটা ছিল ২০১৩ আর এখন ২০২২ মা কিচ্ছু ভুলিনি তো! এসব ভোলা যায়! তুমি আরেকটু একা হয়ে গেলে আমি নিয়ে এলাম তোমায় সন্তোষপুরে একটা ভাড়া বাড়িতে আমার কাছেই একদম। তার কিছুকাল পরেই আমি বাধ্য হয়ে নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে পাকাপাকিভাবে তোমার কাছে চলে এলাম বাবিকে নিয়ে আলো কাকিমার বাড়িতে । যতদিন তুমি বেঁচেছিলে মা, সন্তোষপুরে ভাড়া বাড়ি নেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হত ট্যাক্সি বাড়ির সামনে অবধি যেতে পারছে কিনা আর একতলায় কিনা বাড়ি অবশ্য সব বাড়িওয়ালারাই দেখলাম দোতলায় থাকে আর একতলা ভাড়া দেয়, তাইনা মা? তোমার সাথে আলো কাকিমার বেশ ভাব ছিল। তুমি বারান্দায় এসে বসলে নানান গল্প করতে তোমরা, তবে কাকু অবশ্য বাবি বল খেললে বা দুপুরে আওয়াজ করলে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে “এসব করা চলবেনা এই বাড়িতে থাকতে গেলে” গোছের কথা শোনাতো। মা গো, তুমি চলে গেলে সাথে নিয়ে গেলে সব সাধ স্বপ্ন… ওই বাড়িতে জলের সমস্যার জন্য আমরা এবার এক বছর পরে এলাম পঙ্কজ পালের বাড়িতে,২০১৪ তে তোমার পরপর দুটো ক্যার্ডিয়াক এটাকের পর আশ্চর্যজনক ভাবে আমাদের কাছে আবার ফিরে আসার পরে তোমার ডান দিকের মুখটা সামান্য বেঁকে যায়, ততদিনে তুমি আর মোটেও আয়নার কাছে যেতেনা বলে খুব লক্ষ্যও করতেনা আর আমরা তোমার সাথে কোনো ফটো তোলার সময় বেশী খেয়াল করতাম, করেও চুপ থাকতাম, তুমি তখন ওয়াকার নিয়ে হাঁটতে। পায়ের অবস্থা তখন ভয়ঙ্কর খারাপ! ডাক্তার দেখাতে যাবার সময় গাড়িতে ওঠানো আর নামানো খুবই কষ্টকর আর উদ্বেগজনক বিষয় ছিল। তুমি যতদিন ছিলে, সব সম্পর্কগুলোর বন্ধন দৃঢ় ছিল। যেই তুমি চলে গেলে, বন্ধন আলগা হতে শুরু করল। তুমি ২০১৬র সরস্বতী পূজোর দিন চলে গেলে, বাবি ছিল তোমার চোখের মনি, প্রাণের ধন, চোখে হারাতে ওকে তুমি। বাবিকে নিয়ে গিয়ে সেদিনই আমরা সাইকেল কিনে দিই যাতে ও একটু ভুলে থাকতে পারে তোমাকে হারানোর কষ্ট। শেষ সময়ে বাড়িতে কদিন তুমি একদম খাচ্ছিলে না, কথাও বলছিলে না, ক্রিয়াটিনিন মারাত্মক বেড়ে গেছিল, গা বমি দিত তোমার। আমি চামচ করে খাওয়ালে তুলে দিচ্ছিলে পুরোটা। চুপ করে ওই মাঝের ঘরের ডিভানে একটা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকতে। তখন আর তুমি শরীরের কষ্ট বইতে পারছিলে না এক্কেবারে, আমাকে বলেওছিলে মুখটা কেমন করে “আর পারছিনা “… তুমি ঘুম থেকে উঠছিলেনা, সাড়া দিচ্ছিলেনা। বাবিকে বলেছিলাম “বাবা! তুই ডাকলে দিদুন ঠিক সাড়া দেবে” কিন্তু দিতে পারোনি সাড়া আর পিয়ারলেসে গিয়ে তুমি সুরালের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ নিয়ে মাথা নেড়েছিলে, যেটার মানে একটাই হয়,”আর পারছিনা, এবার ছেড়ে দিন” মাগো! তুমি আমার মা ছিলে না শুধু, ছিলে আমার মেয়েও! কি করে ওই দৃশ্যগুলো সহ্য করেছিলাম আমি জানিনা গো! তুমি চলে গেলে, ওরা তোমার অসার শরীর সাদা কাপড়ে ঢেকে পা দড়ি দিয়ে বেঁধে মাটিতে শোয়ালো… এখানেই শেষ নয়গো! তোমার জন্মসূত্রে পাওয়া অমন সুন্দর রঙ আর পেলব ত্বকের গাল যাদের আমি মাঝেমধ্যেই আদর করতাম তুমি যখন বিছানায় বসে বসে পা দোলাতে, সেই নরম, ঠান্ডা ( মৃত্যুর পরে ) গাল আর পুরো মুখে আমাকে ঘি মাখিয়ে মুখে আগুন দিতে হয়েছিল, তুমি চলে গেলে মা, সেই চলে গেলে! বাকি জীবনটা আমার পুনশ্চে চলে যাবে কোনোমতে… ইতি তোমার ছোট মেয়ে ( তুমি বলতে কোলপোঁছা মেয়ে )ল |