ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে?

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

সম্পূর্ণ মূল প্রবাদটি হল এমন…
 
“স্বামী সে যদিও হয় নেশাড়ু বা খুনে
সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”  
 
রমণী শব্দ‌টির উৎপ‌ত্তি “রমণ” থে‌কে, যার অর্থ স‌ম্ভোগ, আমোদ-প্রমোদ, র‌তি‌ক্রিয়া। অর্থাৎ রমণী শব্দটার মা‌নে দাঁড়ায়, রমণ করার বস্তু। প্রাচীনকা‌লে নারী‌দের প্রতি পুরুষ‌দের দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গি এমনটাই ছিল। য‌দিও এখন তা আর নয় এখন রমণী কেবলি স্ত্রী লিঙ্গকে নি‌র্দেশ ক‌রে।
 
রমণীর আরো একটি সমার্থক শব্দ মহিলা মানে যিনি মহলে থাকেন অর্থাৎ অন্তঃপুরচারিণী। বর্তমানে এ শব্দটিও কিন্তু অচল।
তাহলে বাকি থাকে অন্য সমার্থক শব্দগুলি মানে নারী, স্ত্রীলোক বা গৃহিণী।
 
ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীর “আমিষ ও নিরামিষ আহার” বইতে প্রকাশক ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী সংস্কৃত প্রবাদ “গৃহিণী গৃহমুচ্যতে”-এর অবতারণা করে বলেছেন “গৃহিণী সুগৃহিণী না হলে সংসার শ্মশানে পরিণত হয়। কুগৃহিণীর গৃহ অলক্ষ্মীর আলয়”… এসব কথা এ যুগে কতটা প্রযোজ্য তা বলেই দিয়েছে সময়। কারণ মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি অর্ধেক আকাশের ভাগ বাঁটোয়ারা বেশ বুঝতে শিখেছে। তাই এসব নিয়ে তর্ক বৃথা। তবে আজো কোনো কোনো স্ত্রী’র শ্বশুরঘরের মাথা আরেকজন স্ত্রীলোক মানে তার শ্বশ্রূমাতা কিন্তু কোথাও কোথাও বলতে কসুর করেন না এসব।
অর্থাৎ মেয়েটির স্বামীদেবতার কোনো দোষ নেই। তার সাতখুন মাপ কারণ তিনি হলেন পুরুষ। ইংরেজীতেও বলে এমন “কিং ক্যান ডু নো রং।” কারণ সমাজ শিক্ষিয়ে এসেছে তাঁকে “ছেলের মুতে কড়ি, মেয়ের গলায় দড়ি।” ছেলেদের কাজে ভুল ধরাও যাবে না। তা সে যতই অকাজ কিম্বা কুকাজ হোক। পুরুষ অলস হোন বা নিষ্কর্মা ঘর গেরস্থালি নাকি সুখে বানভাসি হয় স্ত্রীধনের গুণে।
তার মানে রমণী সে শুধু রমণেই আত্মনিয়োজিত করবে নিজেকে সংসার— উপচানো সুখের জন্য। সে আবার মহিলা তাই মহলেই আবদ্ধ থাকবে। সংসারের আদ্যন্ত সুখের মূলে একমাত্র সেই সদা সর্বদা প্রাণ ঢেলে দেবে। দরকার হলে প্রাণপাত করে দেবে। সংসারের দেখভালে পুরুষের কোনো দায় দায়িত্ত্ব কিছুই নেই। স্ত্রী-কে একাই টানতে হবে সর্বপ্রকার ঝুট ঝামেলা। মুখ বুজে, বিনা প্রতিবাদে সামাল দিতে হবে সংসারের সবকিছু। তবেই না সে প্রকৃত অর্থে রমণী রত্ন?
 
আচ্ছা এ প্রবাদের উল্টোটা কী তবে সংসার দুঃখের হয় নারীদের দোষে? নাহ! এখন নারী পুরুষ যুগ ধর্ম মেনে নিয়ে পুরোটা আকাশ নিজেদের মধ্যে সমান করে ভাগ করে নিয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান। মন মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে বৈকি। তারা দু’জনেই আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মহাকাশচারী, বিজ্ঞানী, গবেষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, এঞ্জিনিয়রের পাশাপাশি মেয়েরা পেট্রোলপাম্পে সাবলীলভাবে তেল ভরছে, অটো চালাচ্ছে। শপিংমলে, মাল্টিপ্লেক্সে এমন কি রাতেবিরেতে অ্যাপ ট্যাক্সি চালাতেও সিদ্ধহস্ত তারা। তাহলে? এই দশভুজা মেয়েরা যদি বিয়ের পরে বাবা মায়ের আদরের সংসার ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে স্বামী, সন্তান নিয়ে অন্দরমহলে সামাল দিয়ে বহির্জগতেও সমান তালে দাপিয়ে বেড়ায় তাহলে পুরুষই বা কেন নিজের পেশার পাশাপাশি সংসারের দায়িত্ত্ব স্বেচ্ছায় পালন করবে না?
বরং আমরা সেই প্রচলিত প্রাচীন সেই প্রবাদটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব এক কথায় আর বলব “সংসার প্রকৃতই সুখের হয় উভয়ের গুণে।” স্বামী স্ত্রীর একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা আর উপকারী মনোভাব থাকলেই তবে একটা সুখী, সুস্থ সংসার গড়ে ওঠে। তাই না? তাহলে আর কিসের দাম্পত্য? কেনই বা এই একত্রে দিনের পর দিন এক ছাদের নীচে প্রতিনিয়ত সংসার পালন এবং যাপন?
বিয়ের পিঁড়িতে বসে “যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব” অর্থাৎ ‘আমার হৃদয় তোমার হোক, তোমার হৃদয় আমার হোক।’ সে তো তবে প্রহসনে পরিণত হবে। এ মন্ত্রোচ্চারণেরও কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকেনা।
কাজের সহকারীর অনুপস্থিতিতে একজন আনাজ কেটে দিলেন অন্যজন রান্না করে নিলেন। একজন চায়ের জল বসালেন, অন্যজন রুটি টোস্ট করলেন। একজন টিফিন প্যাক করে দিলেন অন্যজন জলের বোতল। একজন ওয়াশিং মেশিন আনলোড করলেন, অন্যজন জামাকাপড় মেলে দিলেন। ছুটির দিনে দু’জন একসঙ্গে বাজার করে এনে একইসঙ্গে সারা সপ্তাহের বাজার ধুয়ে প্যাক করে ফ্রিজে তুলে রাখলেন। এর মধ্যেও তো অনাবিল এক নিঃস্বার্থপরতা তাই না? নয়ত স্বামী যদি বাজার করে এসেই ফ্যান খুলে খবরের কাগজ কিম্বা ল্যাপটপ অথবা টিভি নিয়ে বসে পড়েন অথবা স্ত্রী যদি স্বামীর ওপর সব দায়িত্ত্ব চাপিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের সঙ্গে ঠিক সেই সময়েই খুটুরখাটুর করেই চলেন তাহলে কিন্তু তা বড়ই বেমানান। সংসার কিন্তু তখন সত্যিই বড়ো দুঃখের এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিজের একান্ত পার্সোনাল কাজ একটু পরেই করুন না। সামান্য সময় ব্যায় করে দুজনেই দুজনের সঙ্গে সহযোগিতা করলে কিন্তু কারোর মোটেও ক্ষতি হবে না। দিনের পর দিন চাপ নিতে নিতে অন্যজন কিন্তু শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া ছাড়াও আপনার প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন অভিমানেও ভেঙেচুরে শেষ হতে থাকবেন। আর তেমন হলে কিন্তু সুখী গৃহকোণ দিনে দিনে অসুস্থ হয়ে পড়বে বৈকি। তাই সবটাই হোক মিউচ্যুয়াল বোঝাপড়ার মাধ্যমে। এ সংসার আমাদের উভয়ের। তার টানাপোড়েন, সুখদুঃখ, চাপানউতোর, হাসিকান্না, বিদেশ ভ্রমণ, মিউচ্যুয়াল ফান্ড সব যেমন আমরা ভাগ করে নিচ্ছি জয়েন্টলি সংসারের রোজকার কাজকর্ম  গুলোতেও তেমনি বোঝাপড়া থাকুক। সে দিন চলে গেছে। এখন নতুন যুগের ভোরে দাঁড়িয়ে আমরা। ছাদ থেকে আপনার নিজের বউয়ের শাড়ি তুললে বা মেললে কেউ আপনাকে গৃহপালিত বলবে না। আবার উল্টোটাও। আপনি যদি সারাদিনের পরে বেশ রাত্তিরে, পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে আপনার স্বামীর কষ্ট হবে বলে পরদিন ভোরের ব্রেকফাস্টের পাউরুটিটা আনতেই যান সেক্ষেত্রেও আপনাকে কেউ সমালোচনা করবে না বরং সাধুবাদ দেবে। আপনিও জানেন যে আপনার পরম কাঙ্খিত এই পুরুষ কিন্তু আপনি অফিস থেকে আগে ফিরলে আপনার চায়ের পেয়ালা পিরীচ নিয়ে এগিয়ে দেন আপনার জন্যই।

Leave a Reply