আশিস চক্রবর্তী

আশিস চক্রবর্তী

প্রতি 
 সম্পাদক মহাশয়


 আমার প্রেরিত  এই পত্র  যক্ষ পুরীর মেঘের মতোই। বুনো প্রেমের বারি পূর্ন এই লেখনী ধারা ,  ধারণ করে আছে অপূর্ণ  হৃদয়ের নির্ঝর। তাই শুরুতেই বলতে ইচ্ছে করে কবির ভাষায় , ” তুমি তো জানো না কিছু , না জানিলে , –
  আমার সমস্ত গান  , তবুও তোমারে লক্ষ্য করেই ! “


বেশ মনে আছে ,  তখনও আকাশের তলায় খানিক আলো বিদ্যমান। আমার পরিত্যক্ত কবিতার খাতায় আধ লেখা কবিতা গুলি ধুঁকছে, প্রেম পাবে বলে। দিগন্ত পেড়িয়ে দৃষ্টি যেদিকে যায় , সেদিকেই দেখি তুমি হঠাৎ এলে !  খাটো করে মোটা কাপড় পরা বনদেবীর ন্যায় ,  এক যুবতীর  বেশে , জলে নেমে শাপলা কি শালুক তুলে চলেছ তুমি ,  পড়ন্ত বিকেলে। গায়ের রং গাঢ় -পুরু। পাথর কেটে গড়ানো শরীরের গড়ন। একটা বুনো গন্ধ নাকে এলে, ওপাশ টাই এগিয়ে যেতেই দেখি, বাঁকানো আড়ি দেয়া চোখে এমন নজরে তাকিয়ে রয়েছ ,যেন কোনো বুনো হরিণ কিংবা রাজহংসী। গলায় কড়ির মালা ,হাতে মৃনাল সমেত আধ ফোটা শালুক। তৎক্ষনাৎ মনে হলো ,বাংলার লাল পেড়ে স্বল্প মূল্যের শাড়িতে যেন দাঁড়িয়ে রূপ যৌবন ধৌত বন পরী কে  দেখছি। মৃদু বাতাসে গালের দু পাশের কাকপক্ষের উড়ন্ত ঝলক যেন প্রখ্যাত কোনো শিল্পীর তুলির আঁচড়।চ্যাপ্টা মাংসল ঠোঁটের ওপর কামনার আস্তরণ মেলে তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলে , ”  কি দেখিস বাবু ? মেয়ে মানুষ দেখিস লাই ? “
আমার ইন্দ্রিয় তখন   গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে অপরূপ সৌন্দর্যের উৎগীরণ।যেন প্রকৃত নারী আমি এই মাত্র অবলোকন করলাম চর্ম চক্ষে। আমার ভেতরে পৃথিবীর সমস্ত প্রেম,পাখির ন্যায় খড় কুটো জড়ো করে এনে হৃৎপিণ্ডের কুঠুরী তে বাসা বেঁধে ফেললো হঠাৎ। চওড়া কাঁধ আর উন্মুক্ত পিঠে ছড়ানো কালো দীঘির মতো চুল বাতাসে সাঁতার কাটছে জলের আল্পনার মতো। সম্মুখে দাঁড়াতেই অনুভূত হলো বুনোহাঁসের পাখার গন্ধ। একরাশ বুকের ভেতর টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম , ”  কি নাম তোমার? “
” ফুলমনি ! ” 
 বলে তুমি আঁচলের খুঁটে শিশিরের মত স্ফটিক রুপী স্বেদ মুছে ছিলে । তোমার নিরাভরণ কম্পিত কানের লতি গোপন ইশারায়, মুহূর্তে সিক্ত করে ছিল আমার  হৃদয়। পঙ্কিল জলাশয়ে নিমগ্ন শেওলার রঙে রাঙা তোমার দুটি চরণের,  এ বুক ,যেন স্পর্শ পেতে চেয়ে উসখুস করে উঠল আমার  । মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেল  ক্রমশ আবেগের স্রোতের স্পন্দন। এক মুহূর্তে মনে হলো তোমাকে প্রকৃতির সমস্ত রং চুরি করে এনে আঁচলে ভরিয়ে দি। তারপর ধীরে ধীরে সে রঙে নিজে হাতে রাঙিয়ে তুলি তোমার সর্বাঙ্গ।আর  সিঁথি জুড়ে বেড়ে উঠুক দুই হৃদয়ের সেতু বন্ধনের চিহ্ন। 


হে প্রিয়তমা , তীব্র আকর্ষণে তুমি টেনেছিলে আমায়।এক মুহূর্তে পূর্ব জন্মের স্মৃতি যেন ফিরে আসে। সেই প্রশস্ত কপাল আর চেড়া চিবুকের মাঝে তিল, হয়তো কোন এক কালে দুজনে হেমন্তের ঝরা পাতার ওপর একে অপরের উষ্ণ নিঃস্বাসে উত্তপ্ত করেছি দেহ। নতুবা প্রাগৈতিহাসিক একটা সংসার পাতা ছিল নিকষ অন্ধকার গিরি গুহায়। কালের স্রোত উল্টো প্রবাহিত এখন। থমকে গিয়েছে ধরিত্রীর এক পাশে হেলে ঘূর্ণন।ক্রম বর্ধমান মেঘ এর সিঁড়ি বেয়ে যেন নেমে এসেছে স্বর্গ লোকের কোনো অভিশাপ প্রাপ্ত  অপ্সরা ,নতুন কোনো ‘মঙ্গলকাব্য’  রচনার ছলে। নয়তো বা দ্বিতীয় ‘কুমারসম্ভব ‘ এর পটভূমি রচিত হতে দেখি সৃষ্টির অগোচরে। মনে হলো এতকাল বুঝি স্তূপীকৃত ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষমান ছিল আমার তৃষ্ণার্ত চিত্ত। মনে প্রশ্ন জন্মায় ! একজন্মে কি আমার  সম্পূর্ণ প্রেম তোমাকে উজাড় করে দেয়া যায় ? 


যুদ্ধের বিজয়ী সৈনিকের মত নিজেকে মনে হলে, আমি জানতে চেয়েছিলাম , ” কোথায় তোমার বাড়ি ? ” 
চঞ্চল বিদ্যুৎ এর মতো তুমি জানিয়েছিলে, ”  ওই পাহাড়তলীর গিরামে। ” 
এক নিমিষে বাস্তবে দেখার মতো সে গ্রাম ফুটে উঠলো মানস পটে।কল্পনায় ফুটে উঠল ,  ফুলমনি যেন আজ বাঙালি ঘরের প্রেমাতুর গৃহবধূ। শঙ্খ শুভ্র শাঁখা পরিহিতা তুলসিমঞ্চে সন্ধ্যা প্রদীপ দেয়। সলতে পোড়া প্রদীপের সেই ঘ্রাণ ভুরভুর করে উঠোন ময়। কখনও বা সদ্য স্নাত ভেজা চুলের গোছা আছড়ে পড়ে মুখে। সশরীরে আশ্রয় নেয় এক মিষ্টি আবেশ। অদ্ভুত স্বর্গীয় সুরভিতে ঘুম আসে আমার। অর্ধ উন্মিলিত চোখের তারায় ভেসে ওঠে তার মুখের আদল।  আলো নিভে এলে সে আমার ঘরে ফেরার আশায় চৌকাঠে আলতা রাঙা চরণ মেলে পথপ্রান্তে চায়। দু এক কথায় সে জানিয়ে ছিল তার,  নাম  না জানা পাখি হবার ভীষণ বাসনা। মেঘের স্রোত কেটে তার উড়বার বড়ো সাধ। অলীক কল্পনার বিষণ্ণতা ছাপ ফুটে  এলে তার মুখে, মনে হয় যেন বুকের পাঁজর কেটে একজোড়া পাখা উপহার দিয়ে নিজেকে সার্থক করি। অথবা পর জন্মে একসাথেই দুজনে বালিহাঁস হই। তারপর রামধনু পেড়িয়ে খুঁজে ফিরি সুখের নীড়।


তোমার  হাসির রোল উঠলে নদীর পাড় জোড়া কাশ ফুলের বনে আন্দোলন রত ভোমরার গুঞ্জন মনে হয়। চলনে, ভরাট রূপের বাঁধন বুঝি আলগা হয়ে আসে।তোমার  লজ্জায় মুখ নিচু হলে মনে হয় সূর্যে গ্রহণ লেগেছে, তাই বুঝি অকাল সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে।  চোখে চোখ রাখলে লক্ষ্য আলোকবর্ষ, পথ অতিক্রান্তের ক্লান্তি দূর হয় পলকে। আমার  বেঁচে থাকবার শেষ আশা বুঝি তুমি । সমস্ত যুগের শেষেও যেন তোমার প্রতি আমার প্রেম জীবাশ্ম হয়ে ধরা দিক ভবিষ্যতের কাছে। অফুরন্ত পাণ্ডুলিপি রচনা হোক তোমার স্বভাব ,কলা ,কৌশলে। দৈব শক্তির বশে যেন ক্ষন কালের জন্য আমি হয়ে উঠি ‘জয়দেব’ আর তুমি  ‘পদ্মাবতী’।


শেষে ,আমার অনুভূত হলো ঘুষঘুষে জ্বরের মতো ভালোবাসার অদৃশ্য ,পুরাতন বন্ধনে তুমি  আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছ আমায়।সুমধুর, নেশাতুর রোগে আক্রান্ত আমার বোধ যেন মাথা কুটে মরে তোমারই চারিপাশে।  মাধ্যাকর্ষণ এর থেকেও দৃঢ় এক মায়াবী টানে সে নিয়ে চললো আমায় প্রেম পুরীর পথে ।নির্জন ,সুবিশাল সে পথের পরিধির শেষে আমার আত্ম সমর্পন।  পরিণতি তে মিলন ।বালির বাঁধের মতো যৌবন চূর্ণ করে ফেলতে চাই নিমিষে সমস্ত সভ্যতার বন্ধন। নরম বাহু ডোরে ঘুর ঘুর করতে চেয়ে শত সহস্র অতৃপ্ত বাসনা জাগরিত হয়ে ঢেউ তোলে অপূরণীয় মনের গহনে। যেন মনে হয় আমি দুষ্মন্ত স্বরূপ প্রথম দর্শনে প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বুনো শকুন্তলার পিছনে ধাবিত হচ্ছি কেবল। অপার্থিব এক শান্তি ,প্রেম ,স্থিরতা বয়ে নিয়ে এসেছ  ফুলমনি তুমি  আমার জীবদ্দশায়।


আশিস চক্রবর্তী

This Post Has One Comment

  1. Nakshatra Raha

    শেষ দশা পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যাচ্ছিল, সৃষ্টির সুর শিকড় সমেত বিচ্ছিন্ন হলে যে পরম শূন্যতা গ্রাস করে আর তা থেকে জন্ম নেয় নিরাসক্ত প্রকৃতি। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।

Leave a Reply