অমিত কুমার সাহা
প্রিয় রবি ঠাকুর, কেমন আছো তুমি? এখানে আমরা বেশ ভালো আছি, আরও গুছিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় ভালো থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত। প্রতি বছরের মতো এবারও”চির নূতনেরে ডাক” দিয়েছিল পঁচিশে বৈশাখ,মানে তোমার জন্মদিন।এখানে ওখানে কতই না জাঁকজমক, তোমার জন্মদিন পালনের;তবে বেশিরভাগই সকালে।আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়তেই পিকনিকের ঘনঘটা,ঐ সকালের বাঁধা মাইকেই হিন্দি গানের বহর; জন্মদিন বলে কথা,তাই একটু সেলিব্রেশন না হলে চলে বলো?আর তখন কতজনের “প্রাণের মাঝে সুধা” ছিল বলা দুষ্কর। তবে বেশিরভাগেরই হাত যে সুধারসে মদিত ছিল তা বলাই বাহুল্য!আর সেই সুধার নাগাল পাওয়া মোটেই খুব একটা কঠিন কাজ নয় ইচ্ছুক যে কারোর পক্ষেই। এদিকে স্কুল কলেজগুলো বন্ধ। দেদার গরম পড়েছিল কি না ক’দিন!তাই বেশ আগে থেকেই ছুটি ঘোষণা। তবে গরম কমলেও নানান টালবাহানায় ছুটি কাটছাঁট? নৈব নৈব চ।ফলত বঞ্চিত হয়ে রয়ে গেলে তুমি,অনেকটাই। কচিকাঁচাদের ছন্দে “মেঘের কোলে রোদ” এবার আর তেমন হাসলো না। অথবা মঞ্চের ওপর থেকে অলক্ষ্যে কেউ আর তার ভালোবাসার গভীর অনুভূতির প্রকাশ করতে পারলো না প্রিয় মানুষটির কাছে,তাই তার “পরাণে যে গান বাজিছে তাহার তাল” আর শেখানো হলো না। তবে কি বলো তো, এখানে এখন আমরা সবাই রাজা। তবে “মোদের রাজার সনে মিলবার কোনো শর্ত” নেই। প্রতিদিনই যেন খেলা ভাঙ্গার খেলা চলছে এখানে। যে শিক্ষার সূচনা করেছিলে তুমি,ভাববাদ আর প্রয়োগবাদের সম্মিলনে;যে শিক্ষার আঙ্গিনায় ছিল ছাত্র-শিক্ষকের আত্মিক সম্পর্ক, এখন আঙ্গিনা রয়েছে সেই শিক্ষাব্যবস্থার, তবে টান কমেছে আত্মিক সম্পর্কের।ছোটো খোকা এখন আর অ আ বলে না; কথা বলা না শিখলেও ABCD তাদের একপ্রকার আয়ত্ত করে ফেলতে হয়,অতি আধুনিকতার চাপে।এদিকে,ছাত্রজগৎ হয়ে উঠছে বেপরোয়া; বাহ্যিক, আভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকেই, আরো আরো বেশি করে দিনের পর দিন। শিক্ষকেরাও নিরুপায়;শাসন করা তো দূরের কথা নেহাত বকুনি দেবার অধিকারও তাদের আর এখন নেই। আর তাছাড়া ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কেইই বা চাইবেন? চাকরি বলে কথা! আর একবার চাকরি গেলে নতুন করে চাকরি পাবার কথা ভুলে যেতে হবে। তরুণ প্রজন্মই এখন চাকরির জন্য রাজপথে; আন্দোলন, মিছিল আরো কত কি! আন্দোলন তোমরাও করেছিলে সেই সময়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল শোষণ থেকে মুক্তির জন্য;আর এখন রুটিরুজির জন্য শিক্ষিত বেকারদের পথে নামতে হয়, পথে নেমেই চিনতে হয় পথ;বাড়তে থাকে বয়স, স্তিমিত হয়ে আসে একসময় আন্দোলনের রূপরেখা। আর এই বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার জীবনে একসময় প্রিয় মানুষটিও হাত ছেড়ে দেয়। মুহূর্তেই চিরন্তন হয়ে ওঠে তোমার লাইনগুলো: “তুমি সুখ যদি নাহি পাও তবে সুখের সন্ধানে যাও।” যত দুঃখ নিয়ে “আমি” নামক হাজারো প্রেমিক হারিয়ে যায় “দারুণ দহন বেলায়”। অদ্ভুত এক রঙের মেলা এখানে। এখান থেকে ঐ যে ওপরে, যেখানে তোমার বাস—-খোলা আকাশের মেঘের মাঝে,নীল সাদার মাধুর্যে; যদি তুমি কখনো সময় পাও, চেয়ে দেখো নীচে একবার।এখানেও নীল সাদায় ভরেছে চারিদিক, প্রয়োজনে,অতি প্রয়োজনে কখনো বা অপ্রয়োজনেও। এখানে সময়ে অসময়ে নীল সাদা আকাশধোয়া জলে যেন নীল সাদা হয় সবকিছু! অনেক নদীতেই এখন বৈশাখ মাসে হাঁটুজল তো দূরের কথা,পাতা জলও থাকে না।কুমোর পাড়া,গরুর গাড়ি প্রায় বিলুপ্ত। তবে বংশী বদন বা ভাগ্নে মদনকে খুঁজে পাওয়া গেলেও যেতে পারে, নিশ্চিতভাবেই তারা এখন চার চাকার সওয়ারি! অনেক কিছুই লিখে ফেললাম তোমায়, রবি ঠাকুর।তবুও হয়ত বাদ গেল অনেক কিছুই। মাঝে মধ্যে মনে হয়, যদি তুমি এই সময়ে জন্মাতে, তাহলে এত গান,এত কবিতা,এত ছোট গল্প,এত নাটক লিখতে পারতে অনর্গল? অথবা লিখলেও সবকিছু বেরোতো তো ছাপা হয়ে?এই তো দেখো না, তোমার গান এখন আমরা শোনার থেকে দেখি বেশি! সঙ্গে বেশিরভাগ সময়ই উপরি পাওনা যন্ত্রের অযাচিত জগঝম্প।অতি- আধুনিকতার আজব উল্লাসে আর মেকি প্রতিযোগিতার সৌজন্যে আমরাই প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে চলেছি “তোমার সুরের ধারা”! তবুও তোমাকেই জাগতে হবে একদিন। তোমার দুর্নিবার লেখনীতে ফের একবার প্রাণে লাগবে সত্যি শিহরণ, ভালোবাসা আর স্বপ্নের হাতছানি। তোমার প্রকাশ হবেই ফের একবার, কুহেলিকা করি উদঘাটন, সূর্যের মতন। ভালো থেকো রবি ঠাকুর। তোমার ফেরার আশায় রইলাম। ইতি—- পথভোলা এক পথিক |