গাছরাক্ষসীর গল্প
অমিতাভ দাস
সৌম্যশংকর আজও ভোরবেলা উঠে গায়ে একটা হালকা সুতির চাদর চাপিয়ে দোতলার দক্ষিণ কোণের জানালাটা খুলে দিলেন। আকাশে হালকা মেঘ। এখন ব্রাহ্ম মুহূর্ত। আরো একটু পর ভোর হবে। ভোরে ওঠা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যেস হলেও এত ভোরে ওঠেন না। আজ যে মহালয়া। পিতৃপক্ষের শেষ, মাতৃপক্ষের শুরু। বড় পবিত্র দিন। বাইরে শিউলি গাছ থেকে গন্ধ আসছে। সৌম্যশংকর ছেলেবেলার মতো গন্ধ টেনে নিলেন। চা আসতে এখনো কিছু দেরি। বড় দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখলেন। এখনো মহিষাসুরমর্দিনী শুরু হতে কিছুটা দেরি আছে। স্মৃতিপথে তাঁর শৈশব আর কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেল। রেডিওটা সাহেব কোম্পানির। এখনো যত্নে আছে। খুব শোনা না হলেও যত্নের কারণে ভালোই আছে বলতে হয়। বাবার আমলে গাঁয়ের অনেক লোক তাঁদের বাড়ির উঠোনে এসে জমা হতো। সবাই বসত শতরঞ্চি বা মাদুরের ওপর। একটা গঙ্গাজলে ধোওয়া জলচৌকির ওপর লাল শালু কাপড় পেতে রেডিওটাকে রাখা হতো। ঠাকুরমা নিজের হাতে কিছু শিউলি ফুল তুলে ছড়িয়ে দিতেন সেই জলচৌকির ওপর। রেডিওর সামনেটা বড় ভালো লাগত। শুরু হয়ে যেত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে সেই চণ্ডীপাঠ…” আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর…” আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ত ছোট্ট সৌম্যশংকর। সেই ভালো লাগা আজও অমলিন আছে। ‘ওই দ্যাখো, পাশের বাড়িতে শুরু হয়ে গেছে’ আপন মনে বলতে বলতে তিনি রেডিওটা চালালেন। বাজলো তোমার আলোর বেণু… শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে খাটে এসে বসলেন পা ঝুলিয়েই। বাবার কথা মনে পড়ল। মায়ের কথা। ঠাকুরমার কথা। সৌম্যশংকর-এর বাবা সত্যশংকর রাধানগর গ্রামের ছোট্ট জমিদার ছিলেন। আদ্যন্ত ভালো মানুষ। যদিও বেশিদিন জমিদারি তাঁর ছিল না। দেশ স্বাধীন হল। জমিদারি চলে গেল। তবু তাঁরা ব্যবসায়ী বনেদি মানুষ। ধানের জমি, পুকুর, চারটে পাটকল ভালোই চলে যেত। বাড়িতে দুর্গামণ্ডপে পুজো হত। গ্রামের লোকজন তিনদিন প্রসাদ পেত। জমিদারি চলে গেলেও সত্যশংকরের খুব মান ছিল। সেই আমলে তিনি গ্রামে একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের স্কুল স্থাপন করেন মায়ের নামে। তাছাড়া নানান কর্মযজ্ঞে তাঁকে পাওয়া যেত সব সময় অকৃপণ ভাবেই। সৌম্যশংকর হয়েছে বাবার মতোই। ছোটোভাই ঋতশংকর অনেক পড়াশুনো করে আমেরিকা নিবাসী। পারিবারিক ব্যবসা জমিজমা সম্পত্তি এসবে খুব একটা আগ্রহ নেই। বছর পাঁচেক আগে শেষবার এসেছিল। সেইবার রায়বাড়ির শেষ পুজো হয়। তারপর পুজো বন্ধ হয়ে যায়। কারণ পাঁচদিনের পুজোর বিরাট কাজ কে করবে? সৌম্যশংকর একা মানুষ। অকৃতদার। মাকে নিয়ে এই বিরাট বাড়িতে থাকতেন। মাও চলে গেছেন বহুবছর। চাকরবাকর তেমন আর কেউ নেই। এখন সর্বক্ষণের সঙ্গী পরিতোষ। আর একজন ঝি আছে রান্নাবান্না করে দেয়। একজন মালি বৃন্দাবন। বাবার আমলের মানুষ। রয়ে গেছে। এদের নিয়েই সত্যশংকরের সংসার। খুট করে একটা শব্দ। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল পরিতোষ, চা নিয়ে এসেছে। ওর হাত থেকে চা নিয়ে সৌম্যশংকর বললে, ‘বোস’। পরিতোষ জানালার কাছে থাকা কাঠের চেয়ারে গিয়ে বসল। ‘এই সময়টা বড় ভালো লাগে পরিতোষ।’ বলে দেওয়ালে ঝোলানো বাবা-মায়ের ছবির দিকে তাকালো সে। চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল। সেজন্যেই মা ঠাকরুণ কতবার কয়েছিল দাদাবাবু আপনারে একটা বিয়ে করতে… —থাক এসব কথা বাদ দে। বলে উঠে দাঁড়ান সৌম্যশংকর। পাশের ঘরে পুরোনো আমলের ফোনটা বেজে ওঠে। ‘এত সকালে কে ফোন করল’ বলে পরিতোষ ফোনটা ধরতে গেল। আরেকটু পরেই গঙ্গায় যাবেন সৌম্যশংকর। তর্পণ করবেন। দান-দক্ষিণা কম দেন না তিনি। সঙ্গে যাবে পরিতোষ। ভাবলেন পুরোহিতমশাই বোধহয় ফোন করেছেন। মনে মনে ভাবছেন ‘এত ভোরে? এখনো তো আকাশবাণীর অনুষ্ঠান শেষ হল না…’ ইতিমধ্যে সুখবরটা নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকল পরিতোষ। ২ ষষ্ঠীর সকালেই চলে এসেছে কালীশংকর তার পরিবার ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে। ঋত এলো না কেন? জ্যাঠামশাই বাবা-মা দুজনেই বেশ অসুস্থ। ওঁরা বললে শীতের দিকে এসে বেশ কয়েক মাস থেকে যাবেন। কালীশংকর অধ্যাপক। ভদ্র মার্জিত। তার দুই ছেলেমেয়ে অমল আর তৃষার সঙ্গে বড়দাদুর খুব ভাব জমে উঠল অল্প সময়ের মধ্যেই। পুজোর কদিন ওরা এখানে কাটিয়ে লক্ষ্মীপুজোর পর আমেরিকা ফিরবে। বাচ্চাদুটো এত মিষ্টি সৌম্যশংকরের কেবল আদর করতে ইচ্ছে করে। ওরাও বড়দাদুর কাছ থেকে পুরোনো আমলের গল্প শোনে, বিক্রম-বেতালের গল্প শোনে। সেদিন সৌম্যশংকর দুপুরে খাওয়ার পর ওদের বটরাক্ষসীর গল্প শোনাচ্ছিল। —বটরাক্ষসীটা আবার কে? জানতে চাইল অমল। —দাদুভাই, সে এক উদ্ভট রাক্ষসী। দু-চোখে তার নাগাল পাওয়া যায় না। সে হল ছায়া বা ধরো ছায়ার মতো। এরা বড় বড় গাছের কোটরে থাকে। এমনিতে ওরা ভালোই। কারো তেমন ক্ষতি করে না। কিন্তু… বলে থেমে গেলেন সৌম্যশংকর । —কিন্তু কী দাদু বলো না… বলে জোর ঝুকুনি দিল তৃষা। —আহা, বলছি বলছি, বলে আবার শুরু করলেন তিনি। ‘কিন্তু ওদের আস্তানা যদি কেউ নষ্ট করে বা গাছ কেটে ফেলে তখন খুব রেগে যায়। বাগে পেলে প্রায় মেরেই ফেলে। আমি তখন খুব ছোটো, ওই যে দূরে নদীর ধারে যে বিরাট বটগাছটা আছে ওটা একটা কাটতে গেছিল চরণ কাঠুরে। সে আমাদের গ্রামেই থাকত। গাছটা কাটার জন্যে সে তার দলবল নিয়ে হাজির। কয়েক ঘা দেবার পর পাখিগুলো আকাশে উড়ল। কোথা থেকে হাওয়া এলো। সঙ্গে একটা গন্ধ। ওরা সেই গন্ধে কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। চরণ কাঠুরে তো অজ্ঞান হয়ে পড়ল। আর মাঝে মাঝে গোঙানির মতো আওয়াজ করছিল। আমার ঠাকুরমা তখন বেঁচে। তিনি খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে চরণের বাঁ হাতের কেনো আঙুলটা খুব জোরে কামড়ে ধরল। আস্তে আস্তে চেতনা ফিরল চরণের। পরে চরণের মুখ থেকে যে ঘটনা শোনা গেল তা খুব ভয়ংকর। ও নাকি গন্ধে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিল। ঘুমের মধ্যে সে দেখল অন্য একটা জগৎ। তার চেনা জগৎ নয়। সবুজ স্যাতস্যাতে কর্দমাক্ত পরিবেশ। একটা কুৎসিত দর্শন দীর্ঘদেহী বৃদ্ধা চুল ছেড়ে বড় বড় দাঁত বার করে চরণকে খপাৎ করে ধরল। শুনতে শুনতে তৃষার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। কী ভয় পেলে নাকি দিদিভাই? তাহলে থাক আর বলে কাজ নেই। বললেন সৌম্যশংকর । —না না। ভয় পাইনি। ভয় পাইনি। শুনবো আমরা বলে অমল আর তৃষা তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে বসল। মৃদু হেসে সৌম্যশংকর আবার বলতে লাগলেন,’ তারপর সেই দীর্ঘদেহী কুৎসিত দর্শন বৃদ্ধা চরণের ওপর চেপে বসল। ধীরে ধীরে চরণের শ্বাসরোধ হতে লাগল। তারপর তো আমার ঠাকুরমা ওর কেনো আঙুল কামড়ে দিল। জ্ঞান ফিরল। —তার মানে এই সেই বটরাক্ষসী। বললে অমল। —ঠিক বলেছ দাদুভাই। আসলে আমার ঠাকুরমা এই গাঁয়ের মেয়ে ছিলেন। পুরোনো দিনের মানুষ। তিনি জানতেন বটরাক্ষসীর কথা এবং তাদের হাত থেকে বাঁচার উপায়। আসলে ওরা স্বপ্ন-কল্পনার মধ্যেই ছায়াশরীরে মানুষকে মেরে ফেলে। আগে বিশেষ এক গন্ধে মানুষের সমস্ত স্নায়ুকে আচ্ছন্ন করে দেয়। তাই তোমরা কখনোই নদীর ধারে ওই বটগাছের কাছে যাবে না কিন্তু। কখন কী হয় বলা যায় না। বললে পরিতোষ। সে পেছনে দাঁড়িয়ে বটরাক্ষসীর গল্প শুনছিল। ৩ পুজোর কটা দিন খুব ভালোই কেটে গেল। আনন্দ আর সুখের সময় দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কদিন পর বাড়িটা আবার ফাঁকা হয়ে যাবে। গাছে জল দিচ্ছিল বৃন্দাবন। কী একটা নতুন জবা গাছ পুঁতছিল সৌম্যশংকর। বললে, হ্যাঁ বেন্দাবনদা, কটা দিন কীভাবে যে চলে গেল। বাচ্চা দুটোর ওপর বড় মায়া পড়ে গেছে। আবার কবে আসবে কে জানে… দুপুর শেষের পড়ন্ত রোদ। হঠাৎ কালীশংকর আর তার স্ত্রী এসে বললে, অমল আর তৃষাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। —সে কী কথা! পরিতোষ আছে? দ্যাখো পরিতোষের সঙ্গে পাড়ার শিবমন্দিরটা দেখতে গেছে হয়ত। —ভাসান দেখতে যায়নি তো? আজ তো দশমী। বললে বৃন্দাবন। —এইটে তো ভালো বলেছ। এইটে তো ভাবিনি বললে কালীশংকর। কী হবে এখন জ্যাঠামশাই? —আহা এত চিন্তা করছ কেন? আমাকে একটু ভাবতে দাও। একটু খুঁজে দেখি। এই কালী, একটা কাজ করো, তোমার মোবাইল থেকে পরিতোষকে একটা ফোন করো তো। ওর সঙ্গে থাকলে সমস্যা তো মিটেই গেল। পরিতোষের কাছে ফোন করলেন কালীশংকর। ফোনের সুইচ অফ। এইবার খুব চিন্তায় পড়ল সকলে। কী হবে এবার… সৌম্যশংকর ভাবলেন থানায় যাওয়া ঠিক হবে কি! পরিতোষ-ই বা কোথায়? ইতিমধ্যে খোঁজ খোঁজ রব চারিদিকে— রায়বাড়ির নাতি-নাতনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দৃপ্ত সাহসী সৌম্যশংকর যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়লেন। কোথায় গেল অমল-তৃষা? **** একটু একটু করে বিকেল নেমেছে। কাঁদতে শুরু করে অমল-তৃষার মা। বৃন্দাবন বয়স্ক মানুষ। অকারণ ভয়ের আশঙ্কায় তার মন কু গাইছে। ইতিমধ্যে রায়বাড়ির সিংহদুয়ার ঠেলে দৌড়ে ভেতরে এসে ঢুকল অমল আর তৃষা। পেছনে সাইকেল হাতে ধরা পরিতোষ। সৌম্যশংকর কাছে গিয়ে বললে তোমরা না বলে কোথায় গেছিলে? —’বলছি বলছি শোনো’। বলে অমল বলতে শুরু করে, ‘দুপুরবেলা আমরা খেয়ে শুয়েছিলাম মায়ের পাশে। জানালার পাশ দিয়ে দুর্গাঠাকুর নিয়ে যাচ্ছিল ভ্যানে করে। ওরা বলছিল, বলো দুর্গা মাঈ কী জয়। আসছে বছর আবার হবে। আমরা ওদের পিছু পিছু অনেক দূর চলে যাই। আমি বললাম, বোন আর যেতে হবে না। এবার ফিরে যাই। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ফেরার কথা ভাবছিলাম সেখানে ওই বিরাট বটগাছটা। বোন বললে, এই গাছে বটরাক্ষসী থাকে। বলতে বলতে ওর চোখ কেমন যেন বড় হয়ে গেল। বললে, দাদা আমি খুব সুন্দর একটা গন্ধ পাচ্ছি। বুঝলাম আমরা বটরাক্ষসীর খপ্পরে পড়েছি। চারপাশে কেউ নেই। ভ্যানে করা দুর্গা প্রতিমা ভাসানে যারা যাচ্ছিল তারা অনেক দূর চলে গেছে। আমিও একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ পাচ্ছিলাম তখন। দেখি বোন গাছের তলায় শুয়ে পড়ল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে ডাকলাম। ও আচ্ছন্নের মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কথা বলতে পারছে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর কেনো আঙুল খুব জোরে কামড়ে ধরলাম। ওর চিৎকার করে উঠল। আমি ওর হাত ধরে জোর ছুট লাগালাম। কিছু দূর আসতেই দেখি সাইকেলে চেপে পরিতোষদাদু কোথায় যেন যাচ্ছেন। তিনি দেখতে পেয়ে আমাদের নিয়ে বাড়িতে এলেন।’ সবাই এতক্ষণ ধরে শুনছিল দুই বালক-বালিকার রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার গল্প। সৌম্যশংকর দুজনকে খুব শক্ত করে নিজের কোলে কাছে এনে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘দাদুভাই তোমার বুদ্ধিতে আজ তোমরা বেঁচে ফিরলে। জানি না কী অঘটন আজ ঘটে যেত।’ |