অন্তরা সরকার

অন্তরা সরকার

প্রিয় রাতুল,
 
অনেকদিন ধরেই ভাবছি তোমাকে একটা চিঠি লিখি। ছোট ছোট মেসেজ নয় একটা বড়ো চিঠি।তুমি সেদিন বললে আমি নাকি আমার কথা তোমাকে কিছুই বলিনা। কিন্তু জানো,আমার বলার চেয়ে শুনতেই বেশি ভালো লাগে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে যখন তোমার কথা ভেসে আসে তখন আমি আনন্দে, উচ্ছ্বাসে খরস্রোতা নদী হয়ে যাই।চুপ করে অনুভব করি তোমাকে,আমার কথা কিছুই বলা হয়না। তাই আমি তোমায় শুধুই গান শোনাতে পারি বন্ধু। “ওগো দুখো জাগানিয়া তোমায় গান শোনাবো।”
আমার বর্তমান সম্বন্ধে কি বলবো রাতুল?আমি এখন ঘড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলা একটা কর্তব্যযন্ত্র মাত্র। তবুও যখন কালো মেঘের ছায়া দেখি আকাশে বা বর্ষার অঝোর ধারায় ভিজতে থাকে বাগানের ফুলগুলো কিংবা গন গনে রোদে তপ্ত দুপুরে কৃষ্ণচুড়া গাছে আগুনের মতো লাল ফুল দেখি,তখন যন্ত্রের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে আমার মন।বাড়ি ফিরে আবার যন্ত্রের শরীরে ঢুকে পড়ি, মা বাবার কাছে বসি কিছুক্ষন।ওঁরা সেই একই কথা বলে যান, হাসিমুখে শুনি।কিন্তু মনে মনে বলি “ক্ষমা করো তোমরা,আমি বাকিজীবনটা একাই থাকতে চাই।”
জয়দীপ চলে যাবার পর আমার জীবনের কাছ থেকে আর কিচ্ছু চাইবার নেই।তবুও জীবন দুহাত ভরে দেয়,যেমন দিয়েছে তোমার মতো বন্ধু।
জানো,মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ,আমি আমার সবটুকু নিয়ে সেই শৈশবেই রয়ে গেছি।কি আশ্চর্য রঙিন মায়াময় রূপকথার মতো শৈশব ছিলো আমার।ছোট থেকেই প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে দেখতাম।আহা, কেমন কাঁচা সোনার মতো রোদ,নীল আকাশ।আমাদের বাড়ির বড়ো ছাদের পাশে একটা লম্বা নারকোল গাছ ছিলো।দুপুরবেলা আমি অপলক চোখে চকচকে পাতাওয়ালা গাছটার মাথার দিকে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম।
 
দিদি ওই ছাদে ওর দলবল নিয়ে ছুটাছুটি করে খেলতো।ও তখন ক্লাস এইট,লম্বা রেশমের মতো চুল আর কাঁচা সোনার মতো গায়ের রং।ওর দলে অনেক ছেলে ও ছিলো।কেউ ওর থেকে ছোট কেউ ওর সমবয়সী।ছাদের যেখানটায় চিলেকোঠার ছায়া পড়তো সেখানে চুপ করে বসে আমি ওদের খেলা দেখতাম। আমাকে ওরা খেলতে নিতো না।রোগা ,একমাথা চুল ,ছোট্ট আমি আকাশ, ডুবন্ত সূর্য আর পাখির ঝাঁক দেখতাম।
 
 মফস্বল শহরটা ছিলো ভীষণ মায়াজড়ানো। আমাদের বাড়ি টা ছিলো দোতলা আর রান্নাঘর টা নিচতলার একধারে আলাদা ছিলো।রান্নাঘরের পরিষ্কার রোয়াকে বিকেলে বেতের মোড়ায় বসে বাবা চা খেতেন।একধারে প্রকান্ড বেলফুলের ঝাড় ছিলো।সন্ধ্যার বাতাস ভারী হয়ে থাকতো সুগন্ধে।
রাতে মা লম্ফো জ্বেলে রান্না করতেন আর আমি ওই আলোয় পড়তাম মায়ের কাছে।কখনও বা অন্ধকার রোয়াকে বসে আকাশ দেখতাম,কত তারা!
খুব বোরিং লাগছে তাইনা রাতুল? কিন্তুকি করবো বলো, আমার ছোটবেলা এরকমই ছিলো।আমাকে জানতে গেলে যে এসব তোমায় জানতে হবে।
 
বাবা সন্ধ্যেবেলা ছাত্র পড়াতেন,মা রান্না করতেন,দিদি দোতলায় পড়া মুখস্থ করতো আর আমি ঘনায়মান অন্ধকারে বসে প্রকৃতিকে অনুভব করতাম।আমার  তেমন কোন বন্ধু ছিলোনা তাই একা থাকার নিজস্ব পদ্ধতিটা খুঁজে নিয়ে ছিলাম।
 
রাতুল,আমার শৈশবের ওই মায়াময় দিনগুলো আমার বাঁচার রসদ।যখন কিচ্ছু ভালো লাগেনা তখন বসে দিনগুলোর কথা ভাবি।সেই আমগাছ যেটা উঠোনে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো তার নিচেই আমার যত খেলা।গাছের নিচে লাল আর হলুদ সন্ধ্যামালতি ফুল ফুটতো বিকেলে।এক শীতের সকালে পুতুলের সংসার সাজিয়ে আমি খেলছি এমন সময় কানে এলো গানটা,”ও তোতা পাখিরে”।আমি খেলা ভুলে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম।মা উপরের ঘরে রেডিও চালিয়েছিলেন।আমার অবস্থা দেখে ছুটে এসে আমাকে কোলে নিয়ে ভোলাতে লাগলেন।জীবনে  আর আমি ওই গানটা শুনিনি।
সেই ছ বছর বয়েস থেকে দুঃখ, বেদনা খুব গভীরভাবে দাগ কেটে যেতো আমার মনে।
আরেকদিন মনে আছে সন্ধ্যেবেলা রান্নাঘরের রোয়াকে মা,বাবা আর বাবার এক বন্ধু গল্প করছেন আমিও বসে আছি।আকাশ ভেসে যাচ্ছে রুপোলি জোছনায়,চারিদিক নিস্তব্ধ।দোতলার কালো ছায়া পড়েছে উঠোনে।এক অপার্থিব দৃশ্যের অভিঘাতে আমি মোহমুগ্ধ।এখনও কিছু গানের সুর আমাকে সেইসব দিনের অনুভূতি ফিরিয়ে দেয়।যেমন লতা মঙ্গেস্করের “মনে রেখো,ওগো আধ চাঁদ” গানটা শুনলে ওই সন্ধ্যের কথা মনে হয় আবার “আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে” গানটা শুনলে ছাদের নারকোল গাছের কথা মনে পড়ে।
আমরা খুব সুখী পরিবার ছিলাম।শুক্রবার রাত আটটায় আর রবিবার আমরা একসঙ্গে রেডিওতে নাটক শুনতাম।শীতকালে আমরা দুবোন তাড়াতাড়ি খেয়ে লেপের তলায় শুয়ে নাটক শুনতাম।মা বাবা বসতেন আমাদের মাথার কাছে।এভাবে কেটে গেলো পাঁচটা বছর।
 
প্রকৃতি,গান,নাটক আমার কানে কি মন্ত্র দিয়েছিল কে  জানে  একদিন একটা নাটক শুনে আমার মনে হলো প্রেম কি আমি জেনে গেছি।নাটকে একটা মেয়ে একটি ছেলেকে বলছিলো,”কাল দুপুরে আমবাগানে দেখা করিস” ।ছেলেটি হেসে বললো,”একলা আমবাগানে তোর আবার কী কথা রে?”।তক্ষুনি আমার মনে বাবাইদার মুখ ভেসে উঠলো।দিদি যাদের সাথে খেলতো তাদের একজন বাবাইদা।ও যখন তখন আমাদের বাড়ি আসতো।
 সারারাত বাবাইদা আমার স্বপ্নে ঘুরে বেড়ালো।
সারাদিন অশান্ত মন নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম।মনে মনে অসংখ্যবার বললাম,”আমি বাবাইকে ভালবাসি”। বিকেলবেলা আমাদের পেয়ারাগাছে উঠে গাছটাকে বললাম” আমি বাবাইকে ভালোবাসি”।
 
তুমি হয়তো ভাবছো ওর সাথে এরপর আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাইনা? আমিতো ঠিক করে ফেলেছি ততদিনে যে আমায় ভালো করে পড়াশোনা করে বাবাইকে বিয়ে করতে হবে।
ভেবেছিলাম ও রোজ আমাদের বাড়ি আসে,আমার সাথে কুল নিয়ে ঝগড়া করে তাহলে ও নিশ্চয় আমাকে ভালোবাসে।কিন্তু আমাকে ও তো মনের কথা বলতে হবে।
এক সন্ধ্যেবেলা ছাদ থেকে সবাই চলে গেলেও খেয়াল করলাম বাবাই যায়নি।এই সুযোগ,আমি দুরুদুরু বুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম।কিন্তু শেষ ধাপে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম।শুনলাম দিদির গলা,”কি বলছিস বাবাই?তোকে আমি ছোট ভাইয়ের মতো দেখি।তুই আমার চেয়ে কত ছোট”।তারপর শুনলাম কান্নাভেজা বাবাইয়ের গলা,”আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবোনা রিমিদি “।আমি আর দাঁড়াইনি, নেমে আসার সময় দিদির গলা পেলাম,” তুই আর আসবিনা এখানে”।
 
প্রেম কি আর ব্যর্থতাই বা কি বোঝার বয়স তখন ছিলোনা আমার।চুপচাপ সব হজম করে নিলাম।বুকটা খালি খালি লাগতো,কী যেন হারিয়ে গেছে জীবন থেকে।
আমি পড়াশোনায় ডুবে গেলাম।আমাকে এমন রেজাল্ট করতে হবে যাতে সবাই চমকে যায়।কার জন্য ,কিসের জন্য এই জেদ বুঝতামনা।
 
বাবাইদা আর আসতোনা।উচ্চমাধ্যমিকে রেজাল্ট খারাপ করলো।তারপর অন্য এক মফস্বলের কলেজে পড়তে চলে গেলো।আমি মাধ্যমিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে ইলেভেনে পড়ছি।একদিন খবর পেলাম পড়তে গিয়ে একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে এনেছে বাবাই।
আরও কয়েক বছর পর আমি তখন ফিজিক্সে অনার্স পড়ি।কলকাতার হোস্টেলে থাকি।এক শনিবার বাড়ি এসে শুনলাম এক ভয়ানক খবর।বাবাইদার বৌ সায়নী আত্মহত্যা করেছে।লিখে গেলো,”আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়”।
 
কালের নিয়মে সব স্মৃতি ফিকে হয়ে গেলো।কলকাতার কলেজে চাকরি পেলাম।জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা এলো জয়দীপকে বিয়ে করলাম।ছোটবেলার ওই ভালোবাসার কথা মনে পড়লে হাসি পেতো।বাবা মা বৃদ্ধ হলেন।আমি মা বাবাকে আমার কাছে কলকাতায় নিয়ে এলাম।আমার ভালোবাসার শহরের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন হলো।দিদি বিয়ের পর আমেরিকায় সেটল করলো ।কত ঘাত প্রতিঘাত,প্রেম অপ্রেম ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে আমরা পরিণত হই।ছোটবেলার আবেগ ,ভালোবাসা,ব্যর্থতা,কান্না সবকিছুই জীবনের অঙ্গ।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার বিপর্যয় নেমে এলো আমার জীবনে।তুমি জানো জয়দীপ দুবছর আগে না ফেরার দেশে চলে গেছে।
আজ বাদে কাল 75 তম স্বাধীনতা দিবস।সারা দেশ সেজে উঠছে অপরূপ সাজে।
গতকাল আমার স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপে আমার প্রিয় ছোটবেলার শহরের কয়েকটি ছবি দেখলাম।একজন মানুষ রাস্তায় পড়ে থাকা পতাকা তুলে সযত্নে তার ঝোলায় ভরছে।একমাথা উলোঝুলো চুল,চোখের তলায় কালি।চমকে উঠলাম,একি? এতো বাবাইদা।
খবর পেলাম বৌ ও ভাবে মারা যাবার পর থেকে মানসিক সুস্থতা হারিয়েছিল।চিকিৎসায় এখন অনেকটা সুস্থ।চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বললাম,”স্যালুট ইউ বাবাইদা”।
কিভাবে জীবন আমাদের নিয়ে খেলা করে তাইনা।যাইহোক অনেক রাত হলো।তোমার সাথে মুখোমুখি বসে এতো কথা আমি কোনোদিনই বোধ হয় বলতে পারতামনা।তুমি আর আমি আমাদের জীবন থেকে শিখেছি প্রেমের পর ই বন্ধুত্বের মতো মহান অনুভূতি আর হয়না।আমরা চিরকাল বন্ধু থাকবো রাতুল,জেন্ডারলেস শুধু বন্ধু।
ভালো থেকো_  ___ মৃত্তিকা

Leave a Reply