মেনোপজ মানেই কী যৌনজীবনে ফুলস্টপ?
অদিতি সেনগুপ্ত
এই ২০২৪-এর গোড়ায় দাঁড়িয়েও ভারতবর্ষের বুকে সবচাইতে গোপনীয় বিষয় হোলো যৌনতা! আর তা যদি হয় নারীদের যৌন আকাঙ্খা বিষয়ক তাহলে তো সেটা রীতিমত নিষিদ্ধ! কথাটা শুনতে অবাক লাগলেও এটা একশ ভাগ সত্যি। আমাদের সমাজে একটি মেয়ে যখন ঋতুমতী হয়, অর্থাৎ তার মাসিক রক্তক্ষরণ শুরু হয় তখন থেকে সমাজের চোখে সে একজন নারী এবং এটা তাকে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিপলে মনেও করিয়ে দেওয়া হয়। আবার ঠিক তেমনই, রজঃনিবৃত্তির সময়েও তাকে অস্ফুটে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে এখন থেকে সে একজন অ-নারী! রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজ আসলে কী? মেনোপজ হল শরীরের মধ্যে একটা আমুল হরমোনাল পরিবর্তন এবং তা কিন্তু পুরুষ নারী উভয়েরই হয়ে থাকে। কিন্তু পুরুষের জন্য কোথাও কোনও ফিসফাস ভেসে আসেনা যে তুমি এখন থেকে অ-পুরুষ। তারওপর নারীটি যদি কোনো মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের অংশ হয় তাহলে তো তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে তার মননে মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় প্রজনন এবং স্বামীর সর্বক্ষেত্রে উন্নততম পরিষেবা প্রদানই তার জীবনের মূল লক্ষ্য। আর নারীর যৌন তৃপ্তি নিয়ে ভাবনাচিন্তা, সে তো নৈব নৈব চ! এটা একটা বৈজ্ঞানিক সত্য যে নারীর শরীরে যৌন উত্তেজনা আসতে কিছুটা সময় লাগে, অপরপক্ষে পুরুষ অনেক দ্রুত উত্তেজিত হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেই উত্তেজনার প্রশমনও ঘটে দ্রুত। আর এর ফলস্বরূপ বেশিরভাগ নারীই তার জীবনে প্রকৃত যৌন তৃপ্তিলাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অবশ্য এ নিয়ে সমাজের কোনও মাথাব্যথা কখনও ছিলনা, নেই আর হবেও না। বরং এ বিষয়ে যদি স্বামী বা পার্টনারের কাছে নারীর মুখ ফোটে তাহলে তার চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্নদৃষ্টি ফুটে ওঠে পুরুষের চোখেমুখে! ছোট থেকেই শেখানো হয়, “লজ্জা নারীর ভূষণ”—তাই বুক ফাটলেও মুখ ফোটা চলবে না! আসলে খিদে, ঘুম এসবের মতই যৌনতাও যে খুব স্বাভাবিক একটি জৈবিক চাহিদা একথা মানতে নারাজ আমাদের তথাকথিত সমাজ। খিদে না মিটলে আমরা তো খাদ্যগ্রহণে কার্পণ্য করিনা। শুধু এবিষয়টিই বড্ড অবহেলিত। শুধু ভারতবর্ষেই যে এই পরিস্থিতি তাই বা বলি কী করে। মনে করা যাক বাইবেলের সেই অধ্যায়, পৃথিবীর আদি মানব-মানবী আদম ও ইভ। কিন্তু আদম আদি মানব হলেও ইভ ছিল দ্বিতীয়। আসলে স্বেচ্ছাচারি নারীকে সকলেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে ফেলে বা ফেলতে চায়। আর তাই লিলিথকে ব্রাত্য রাখা হয় আদিমানবীর আখ্যা থেকে। কারণ রতিসুখের চরমে পৌঁছনোর জন্য লিলিথ যৌনতার আদি অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে উত্থিত হয়েছিল তার পুরুষে। তাই সমাজে তার অকাল বিস্মৃতি ঘটেছিল। যাইহোক যে বিষয়ে মূলত লিখতে বসা, সেই মেনোপজ প্রসঙ্গে আসা যাক। মেনোপজ প্রতিটা মেয়ের জীবনে খুব স্বাভাবিক এবং অনিবার্য একটি ঘটনা। কিন্তু যুগ যুগ ধরে একটা অস্বাভাবিকতার মোড়কে আড়াল করে রাখা হয়েছে একে। ফলে নারীর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে বসে আছে যে, মেনোপজ মানেই তার নারীত্বের মৃত্যু! অর্থাৎ এখন আর তার যৌন চাহিদা থাকা উচিৎ নয়, বরং ধর্মেকর্মে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করাটাই এখন তার অবশ্য কর্তব্য! কিন্তু তা তো সত্যি নয়। মেনোপজের সঙ্গে যৌন আকাঙ্খার কোনও সম্পর্ক নেই। আবার এটাও নয় যে মেনোপজের পরে শরীরের কোনই পরিবর্তন ঘটে না। ঘটে তো নিশ্চয়ই। ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা মেনোপজের পর কমবেই এবং তারজন্য শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন আসবেই। কীরকম সেই বদল? ◆ হটফ্ল্যাশ বা হঠাৎ উষ্ণতা যা আপনার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে প্রায়শই। ◆ কোল্ড ফ্ল্যাশ বা ঠাণ্ডার ঝলক। রাত্রে হঠাৎ কাঁপুনি সত্ত্বেও শরীরে ঘাম। ◆ ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ। ◆ ত্বকের ঔজ্জ্বল্য হ্রাহ ◆ শুষ্ক ও প্রদাহভরা যোনি ◆ স্থুলতা এই সব বদলই ঘটে ইস্ট্রোজেনের অভাবে। ঘটলই বা বদল। কিন্তু তারজন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাহ্যিক খুঁত খুঁজে শুধু শুধু মনের ওজন বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কী? তারচাইতে দেহের ওজন নাহয় বাড়ুক খানিক, ত্বক হারাক তারুণ্য তবুও ভালোবাসা থাক যত্নে। কারণ প্রকৃত ভালোবাসার বাস তো অন্তরে। সুতরাং যা অবশ্যম্ভাবী তা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে মানসিক কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ? বরং সমাজ কী বলবে সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিজ্ঞানসঙ্গত যা যা করনীয় সেটাই করা বাঞ্ছনীয় নয় কী? একটা বিষয় পুরুষকেও বুঝতে হবে যে যৌনতা মানেই কিন্তু পেনিট্রেশন নয়। একজন নারীর যৌনতায় স্পর্শের ভূমিকা অপরিসীম। যদি কেউ মনে করেন হাত ধরার মধ্যে আবার যৌনতা কী? তাহলে বলি, দেহের সবচাইতে স্পর্শকাতর অঙ্গ হচ্ছে ত্বক, তাই মাথার চুল থেকে পায়ের নখ, সবখানেই প্রবল অনুভূতি।আর যৌনতা মাত্রই একটা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। তাই মেনোপজের পরেও আলতো ঠোঁটের পরশে একটা নতূন সূর্যোদয় তো হতেই পারে। চাইলে সেই জীবনটাও হতে পারে পালকের মত নির্ভার। |
খুব ভালো লাগল লেখাটা। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র নারী নাম নিয়ে চেঁচামেচি না করে নারীজীবনের আসল একটি সমস্যা তুলে ধরেছেন লেখিকা। ইনফরমেটিভ এই লেখা সকলের পড়া উচিত।
(পিয়াংকী)